<p>খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল ইউরোপ ও মুসলিম প্রাচ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগ। তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্য এ সংযোগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছিল। আষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পশ্চিমারা উসমানীয়দের নিয়ে ভীত থাকলেও ফ্রাঙ্কো-অটোমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে সুলতান প্রথম সুলাইমান সে ভয় দূর করেন।</p> <p> </p> <p>পশ্চিমের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক</p> <p>১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিদের ভিয়েনা অবরোধ ব্যর্থ হয়। এ যুদ্ধ তুর্কিদের ইউরোপ জয়ের ধারাকে ব্যাহত করে। তখন জয়ের পরিবর্তে অর্জিত ভূখণ্ড রক্ষায় বেশি মনোযোগী হয়। যুদ্ধ জয়ের পরিবর্তে তুর্কিরা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকেও গুরুত্ব দেয়। সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় সাম্রাজ্যের দূত ফ্রান্স সফর করে। এ সফরের মাধ্যমেই ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।</p> <p> </p> <p>ইউরোপে তুর্কি শিল্পকলার প্রসার : </p> <p>১৭২১ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি রাষ্ট্রদূত মেহমেদ সেলেবি, যিনি ইয়ার্মিসেকিজ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তুর্কি শিল্পকলা জনপ্রিয়তা লাভ করে। ঐতিহাসিকরা এই সময়টাকে ‘টিউলিপ যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। উসমানীয় সাম্রাজ্য তখন শিল্প ও সংস্কৃতির সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেছিল। এ যুগের স্থাপত্যশিল্পের মোটিভগুলোকে একক টিউপের আদলে চিহ্নিত করা যায়, যা পশ্চিমা বিশ্বে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। মেহমেদ সেলেবি ও তাঁর কর্মচারীদের পরিচ্ছন্ন তুর্কি শিল্পকলা ও নান্দনিকতার চর্চায় প্যারিসে তুর্কি রীতি গভীর প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে তা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং তুর্কি শিল্পরীতি ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। মধ্য ইউরোপেই তুর্কি প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল। যেখানে জার্মানির নগর রাষ্ট্রগুলো ও অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অবস্থান ছিল। কারণ এসব অঞ্চলের বেশির ভাগ তুর্কিরা জয় করতে পেরেছিল।</p> <p> </p> <p>তুর্কি শিল্পকলা ও স্থাপত্যরীতির প্রভাব : সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ চার-পাঁচ শতাব্দী ধরে উসমানীয় স্থপতি ও শিল্পীরা স্বতন্ত্র তুর্কি স্থাপত্যরীতি দাঁড় করিয়েছিল, যা ইউরোপীয়দের আকর্ষণ করেছিল এবং তারা তা অনুসরণও করত। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফার্নিচার ডিজাইনার ‘থমাস শেরাটন’-এর বই ‘দ্য ক্যাবিনেট ম্যাকার অ্যান্ড আপহোলেস্টারস ড্রয়িং বুক’-এ তুর্কি স্থাপত্যরীতির প্রভাব দেখা যায়। তুর্কি শিল্পকলা ও স্থাপত্যরীতির প্রভাবে ইউরোপের স্থাপত্যরীতি যেসব ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো,</p> <p> </p> <p>তুর্কি কক্ষ : ভিয়েনা যুদ্ধের পর তুর্কি সেনাবাহিনী অস্ত্রসহ বহু মূল্যবান সামগ্রী ফেলে রেখে আসে। অভিজাত ইউরোপীয়রা এসব সামগ্রী সংগ্রহ শুরু করে যেন পরে তা প্রদর্শন করতে পারে। প্রথমে জার্মানির স্যাক্সিনের প্রিন্স ইলেক্টর ফেডরিক ক্রিশ্চিয়ান তাঁর পরিবারের সংগৃহীত প্রাচ্যীয় অস্ত্রগুলো প্রদর্শনের জন্য ড্রিজডেন প্রাসাদে তুর্কি স্থাপত্যরীতিতে একটি কক্ষ তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের অন্যান্য শাসকরাও এ ধারায় যুক্ত হন। তাঁরা তুর্কি স্থাপত্যরীতিতে বিশেষ কক্ষ তৈরি করতেন, যেখানে উসমানীয়দের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ও সংগৃহীত জিনিসগুলো প্রদর্শন করতেন। ক্রমেই তুর্কি স্থাপত্যরীতি প্রদর্শনী কক্ষ থেকে ইউরোপের সামগ্রিক স্থাপত্যরীতিতে জায়গা করে নেয়। তুর্কি কক্ষগুলো ছিল যাযাবর তাঁবুসদৃশ। যেখানে বসা, বিশ্রাম নেওয়া, উষ্ণতা গ্রহণ, খাবার প্রস্তুত ও খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এসব রুম হতো জ্যামিতিক আকৃতির।</p> <p> </p> <p>ফরাসি রানির তুর্কি কক্ষ : বিখ্যাত ফরাসি রানি মেরি অ্যান্টোনেট—ফরাসি বিপ্লবের পর যাকে হত্যা করা হয়, তিনি রাজপ্রাসাদে তুর্কি কক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর কক্ষে ইউরোপীয় রীতি অনুসরণ করা হলেও তাতে তুর্কি রীতিই ছিল প্রবল। কক্ষের সামগ্রিক নকশায় তুর্কি রীতি অত্যন্ত দৃশ্যমান। ফরাসি বিপ্লবের বহু বছর পর সংস্কার শেষে কক্ষটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।</p> <p> </p> <p>তুর্কি বাড়ি : তুর্কি সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন হলো তার ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। সপ্তদশ শতাব্দীতে উসমানীয়রা সেসব শহর জয় করেছিল এবং যেসব শহরে বসতি স্থাপন করেছিল সেখানে তারা বিশেষ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এসব বাড়ি স্থাপন করেছিল। খোলা প্রাঙ্গণ, প্রাসাদের বহির্ভাগ ও বিশেষ অভ্যন্তরীণ নকশাবিশিষ্ট বাড়িগুলো ইউরোপীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তুর্কি প্রভাবিত অঞ্চলে এ ধরনের বাড়ির প্রচলন এখনো দেখা যায়। তুর্কি বাড়িগুলোর প্রবেশভাগে থাকে ‘সেলামিক’ নামক একটি পুরুষ অভ্যর্থনা কক্ষ, এর পেছনে থাকে ‘হারেমলিক’ নামে নারী অভ্যর্থনা কক্ষ। একইভাবে বাড়ির বাগানে নারীদের জন্য থাকে দেয়ালঘেরা অঞ্চল।</p> <p> </p> <p>বাড়ির অঙ্গসজ্জায় তুর্কি চিত্রকলা : ইউরোপে বাড়ি বা প্রাসাদের সাজ-সজ্জায় চিত্রকলার ব্যবহারের যে প্রচলন তার সঙ্গে তুর্কি ঐতিহ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। উসমানীয় প্রাসাদগুলোয় ল্যান্ডস্কেপ ছবি ব্যবহারের রীতি ছিল। ইউরোপীয় দূতরা বিভিন্ন সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য সফরে গিয়ে এসব চিত্রকলা সংগ্রহ করেন এবং ধীরে ধীরে ইউরোপে তার চর্চা শুরু হয়। ফরাসি চিত্রশিল্পী চার্লস আন্দ্রে ভ্যান লু-এর চিত্রকর্মকে ইউরোপে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে দেখা হয়। শিল্পী তাঁর বহু চিত্রকর্মে তুর্কি উপাদান ব্যবহার করেছেন। তিনি জিন অ্যান্টোনেট পেইনসনের প্রাসাদের বহির্ভাগ সজ্জিত করেন। এ কাজে তিনি নিজস্ব শৈলী ও অলংকরণে তুর্কিদের প্রাত্যাহিক জীবন তুলে ধরেছেন। শুধু দেয়ালে নয়, প্রাসাদের কার্পেটগুলোতেও তুর্কি চিত্রকলার প্রভাব আছে।</p> <p>তথ্যসূত্র : ডেইলি সাবাহ।</p>