রাসুলুল্লাহ (সা.) কথা ও কাজে মধ্যপন্থা পছন্দ করতেন এবং অন্যকেও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলেন, ‘কাজে-কর্মে মধ্যপন্থাই উত্তম।’ মহানবী (সা.)-এর জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মধ্যপন্থা অবলম্বনের বহু দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তিনজন সাহাবি ঈমানি চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে এলেন। একজন বললেন, আমি সারা রাত ইবাদত করব, আরেকজন বললেন, আমি সব সময় রোজা রাখব এবং তৃতীয়জন বললেন, আমি কখনো বিয়ে করব না। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের নিষেধ করে বললেন, আমি তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহভীরু ও মুত্তাকি। আমি রাতে ইবাদত করি এবং রাতে ঘুমাই, রোজা রাখি এবং রোজা ছেড়েও দিই, আমি বিয়েও করেছি। যে আমার পথ অনুসরণ করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
অনুরূপ হজের সময় একজন সাহাবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, ‘আমি আমার সব সহায়-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেব। মহানবী (সা.) পরামর্শ দিলেন, পুরো সম্পদ দান কোরো না। তখন তিনি অর্ধেক সম্পদ দান করতে চাইলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, এক-তৃতীয়াংশ দান করো। সন্তানদের জীবনধারণের মতো সম্পদ রেখে যাওয়া উত্তম তাদের নিঃস্ব ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে, যেন তাদের অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়।
এক সাহাবি মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে দিন যাপন করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি কোনো আসবাব আছে? তিনি বললেন, একটি পেয়ালা ও একটি চাদর আছে। রাসুল (সা.) বললেন, নিয়ে এসো। সাহাবি নিয়ে এলে তিনি তা দুই দিরহামে বিক্রি করে দিলেন। তাকে বললেন, তুমি এক দিরহাম দিয়ে নিজের ও পরিবারের জন্য খাবার কিনবে। আরেক দিরহাম দিয়ে রাসুল (সা.) একটি কুড়াল কিনলেন এবং নিজ হাতে হাতল লাগিয়ে দিলেন। তাকে বললেন, এটা দিয়ে তুমি কাঠ কেটে জীবিকা উপার্জন করো।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে দুই ভাই ছিলেন। তাঁদের একজন দ্বিন শেখার জন্য মহানবী (সা.)-এর দরবারে হাজির হতেন এবং অপর ভাই জীবিকা উপার্জন করতেন। একদিন উপার্জনকারী ভাই রাসুল (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করে বলেন, এ আমার ভাই। সে হাত গুটিয়ে বসে থাকে এবং আপনার দরবারে পড়ে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে যে, তোমার ভাইয়ের দ্বিন শেখার কারণে তোমার উপার্জনে বরকত হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ তাকে এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের প্রচেষ্টাই শেষ কথা নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছাও এখানে কার্যকর।
মদিনার আনসার সাহাবিরা কৃষিকাজ করতেন। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর জিহাদ ও অন্যান্য দ্বিনি কাজের জন্য সাহাবিরা কৃষিকাজে ঠিকমতো সময় দিতে পারছিলেন না। তখন তাঁরা দ্বিধাগ্রস্ত হলেন—কৃষিকাজে মনোযোগ দিয়ে আয়-উপার্জন বৃদ্ধি করবে নাকি দ্বিন প্রচারে আরো বেশি মনোযোগী হবেন। তখন আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ো না।’
এভাবেই মহানবী (সা.) সাহাবিদের মধ্যপন্থার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি তাদের শিখিয়েছিলেন যে, তোমরা পার্থিব জীবনের প্রয়োজন পূরণে দরকারি চেষ্টা করবে এবং দ্বিন পালনেও যত্নশীল থাকবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইসলাম সহজ-সাবলীল ধর্ম। আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদির জন্য দ্বিনকে সহজ করে দিয়েছেন। তা এভাবে যে, ইসলাম মানুষের পার্থিব জীবনের প্রয়োজন এবং পরকালীন জীবনের উপার্জনের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্য বিধান করেছে। যেন এক জীবনের প্রতি মনোযোগী হলে অন্য জীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর
মন্তব্য