<p>কাউকে বিনিময়বিহীন কোনো কিছুর মালিক বানানো, যা অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর কার্যকর হবে—এটাকে ইসলামের পরিভাষায় অসিয়ত বলা হয়। মুসলমানদের প্রতিদিনের কাজকর্ম সাফ রাখা জরুরি। কারো সঙ্গে দেনা-পাওনা থাকলে তা লিখে অসিয়ত করে রাখা উচিত। একজন মুসলিম পার্থিব জীবনে এমনভাবে থাকবে, যেভাবে একজন সিপাহি সীমান্তচৌকিতে পাহারারত থাকে। যে মুহূর্তেই তার প্রস্থানের নির্দেশ আসবে সে এর জন্য প্রস্তুত। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে মুসলিমের অসিয়ত করার মতো কোনো বিষয় রয়েছে, তার জন্য উচিত নয় অসিয়ত অলিখিত অবস্থায় দুটি রাত অতিবাহিত করা।’ (বুখারি, হাদিস : ২৭৩৮)</p> <p>অসিয়তের প্রকার : অসিয়ত চার প্রকার। এক. ওয়াজিব : নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজসহ আল্লাহ ও বান্দার যেসব হক অনাদায় থেকে যায় সে সম্পর্কে অসিয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব। দুই. মুবাহ : ধনী ব্যক্তির সম্পদ সম্পর্কে অসিয়ত করা মুবাহ বা বৈধ। তিন. মাকরুহ : পাপাচারীর জন্য অসিয়ত করা মাকরুহ। চার. মুস্তাহাব : এ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে মুস্তাহাব। (দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার : ৫/৩১৫)</p> <p>অসিয়তের অনুকূলে সাক্ষ্য : অসিয়তের সময় দুজন সাক্ষী রাখা উচিত, যেন পরবর্তী সময়ে মতানৈক্য সৃষ্টি না হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের কারো যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন অসিয়ত করার সময় তোমাদের থেকে দুজন ন্যায়পরায়ণ লোকের সাক্ষী রাখবে।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১০৬)</p> <p>যে পরিমাণ সম্পদে অসিয়ত করা যায় : সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অসিয়ত করা জায়েজ। এর চেয়ে বেশি অসিয়ত করা জায়েজ নয়। তবে যদি অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর ওয়ারিশরা এক-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদেও অসিয়ত অনুমোদন করে, তাহলে সে অসিয়ত বৈধ হবে। তবে শর্ত হচ্ছে ওয়ারিশরা প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৬৮)</p> <p>অসিয়ত প্রত্যাহার : অসিয়তকারীর পক্ষে অসিয়ত কোনো চুক্তি নয়। কাজেই অসিয়ত করার পর যত দিন সে জীবিত থাকে, তত দিন তা প্রত্যাহার করার অধিকার তার থাকে।</p> <p>ঋণ পরিশোধের অসিয়ত করা : যেসব হক আদায় করা ওয়াজিব তার জন্য অসিয়ত করাও ওয়াজিব। যেমন—একজন ঋণ নিয়েছে। তার কর্তব্য হলো, এই অসিয়ত করে রাখা যে, তার সম্পদ থেকে যেন এ ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ঋণের খবর ঘরের লোকদেরও জানা থাকে না। এমতাবস্থায় তার মৃত্যুর পর জানা না থাকার কারণে কাছের লোকেরাও তা পরিশোধ করতে পারে না। ফলে এ হক তার জিম্মায় থেকেই যায়। ঋণ শোধ হয় না। সেও দায়মুক্ত হতে পারে না।</p> <p>নামাজ-রোজার ফিদয়ার অসিয়ত : কারো জীবনে কোনো নামাজ-রোজা কাজা হয়ে থাকলে জীবদ্দশাতেই তা আদায় করে ফেলা উচিত। যদি কাজা আদায়ের সুযোগ না পাওয়া যায়, তাহলে এই মর্মে অসিয়ত করে যাওয়া ফরজ যে আমার জিম্মায় এত নামাজ, এত রোজা কাজা রয়েছে। এগুলোর ফিদয়া যেন আদায় করা হয়। যদি কেউ এমন অসিয়ত না করে, তাহলে যে গুনাহগার হবে।</p> <p>জাকাত আদায়ের অসিয়ত : কারো ওপর কয়েক বছরের জাকাত ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও সে আদায় করেনি। তার কর্তব্য বিগত বছরগুলোর হিসাব করে জাকাত আদায় করা। জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ আদায় করতে না পারলে মৃত্যুর পূর্বে অন্তত অসিয়ত করে যাবে যে, আমার এ পরিমাণ জাকাত অনাদায়ি রয়ে গেছে। তা যেন আদায় করা হয়। অন্যথায় গুনাহগার হবে।</p> <p>বদলি হজের অসিয়ত : কারো ওপর হজ ফরজ হয়েছে। কিন্তু আদায় করতে পারেনি। তার কর্তব্য হলো, বদলি হজের অসিয়ত করে যাওয়া। অসিয়ত না করলে দ্বিগুণ গুনাহ হবে। প্রথমত, ফরজ আদায় না করার গুনাহ। দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর আগে অসিয়ত না করে যাওয়ার গুনাহ।</p> <p>মৃত্যু-পরবর্তী অঙ্গদানের অসিয়ত : মানুষের স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর তার মালিকানা স্বত্ব নেই। তাই এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা অন্যের কাছে হস্তান্তর করার অধিকারও মানুষের নেই। আর অসিয়ত তথা উইল কেবল স্বীয় মালিকানাধীন সম্পদের মধ্যেই করা যায়। তাই মৃত্যু-পরবর্তী অঙ্গদানের উইলের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ইসলামে নেই। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৮১৫২, দুররুল মুখতার : ১০/৩৩৭)</p> <p>নির্দিষ্ট ব্যক্তি দ্বারা জানাজা পড়ানোর অসিয়ত : কেউ নির্দিষ্ট ব্যক্তি দ্বারা জানাজা পড়ানোর অসিয়ত করে গেলে তার অসিয়ত পূরণ করা কতটুকু জরুরি? এর জবাব হলো, অসিয়তকৃত ব্যক্তি যদি শরিয়ত কর্তৃক জানাজা পড়ানোর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত না হয়ে থাকে, তাহলে এ ধরনের ব্যক্তির ব্যাপারে মাইয়েতের অসিয়ত পূরণ করা জরুরি নয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিই জানাজা পড়াবেন। অসিয়ত বাতিল বলে গণ্য হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২২৪)</p> <p>গুনাহের কাজের অসিয়ত : গুনাহের কাজের অসিয়ত করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং তা পূর্ণ করা যাবে না। করলে গুনাহ হবে। (রদ্দুল মুহতার : ১০/৩৯৭)</p> <p>আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p> </p> <p>লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।</p> <p> </p>