<p>হিজড়া শব্দটি এখন বহুলাংশে গালির সমার্থক। কারো প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে কেউ কেউ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। যদিও হিজড়া শব্দটির দাপ্তরিক ভিত্তি নেই—দাপ্তরিক শব্দ তৃতীয় লিঙ্গ। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তারা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ সম্প্রদায়ভুক্ত। হিজড়াদের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও তাদের সামাজিক অবস্থানের পেছনে যেমন তাদের অসংযত জীবনযাপন দায়ী, তেমনি তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে সামাজিক দৃষ্টিকোণও কম বড় বাধা নয়। স্বাভাবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের সুযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে হয়তো এত অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যেত না।</p> <p>ইসলাম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পূর্ণ মানবিক মর্যাদা দিয়েছে। মসজিদসহ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তাদের সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণের অবকাশ রয়েছে ইসলামী শরিয়তে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইনেও তাদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র কি তাদের এই অধিকার রক্ষায় সক্রিয়? না একজন মুসলিমের সন্তান হিসেবে তারা ধর্মপালনের অধিকারটুকু পাচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তাদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। আর সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই ঢাকার একদল তরুণ আলেম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ভেতর ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার করা এবং তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।</p> <p>সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে তরুণ আলেমদের উদ্যোগে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য তিন দিনব্যাপী কোরআন ও নামাজ শিক্ষার আয়োজন করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই আয়োজনে প্রায় ৩০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অংশগ্রহণ করে। তাদের ঈমান ও নামাজসহ কিছু মৌলিক বিষয় শেখানো হয়েছে। </p> <p>উদ্যোক্তা আলেমদের অন্যতম মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। নিজেদের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান দেখে আমাদের কষ্ট লাগত। ভাবতাম একটি মানবিক জীবন তাদের প্রাপ্য। ঈমান ও ইসলাম তাদের অধিকার। তাদের অনেকেই জানে না আল্লাহর বান্দা হিসেবে তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে এবং পরকালে তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে। তাদের ভেতর ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যেই আমাদের এই উদ্যোগ। আশা করি, ঈমান ও ইসলামের শিক্ষা পেলে তাদের জীবনে শৃঙ্খলা আসবে এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে যাবে।’</p> <p>ঈমানি দায়িত্ববোধ থেকেই তারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন বলে দাবি করেন মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় তৃতীয় লিঙ্গের কোনো মানুষ দেখলে দাঁড়াতাম, পিছু পিছু যেতামও কিন্তু কথা বলার সাহস হতো না। কখনো কখনো তারা বিরক্তি নিয়ে তাকাত। শেষ পর্যন্ত ‘হিজড়াদের কোরআন শেখানো হয়’ লিখে পোস্টারিং করি। এভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ধীরে ধীরে তাদেরও সংকোচ কাটে এবং দ্বিন শেখার ব্যাপারে তারা আগ্রহী হয়। এটা আমাদের তৃতীয় আয়োজন। প্রথম দুইবার তাদের শুধু দ্বিনি উপদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তৃতীয়বার ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয় শেখানো হয়েছে।’</p> <p>এবারের আসরে কালেমা, পবিত্রতা, নামাজ ও তাদের বিশেষ কিছু মাসায়েল ও চারটি সুরা শেখানো হয় এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়। ‘দ্বিনের এই সামান্য শিক্ষাটুকু পেয়ে যে আবেগ ও অনুভূতি তারা প্রকাশ করে তা সত্যিই হৃদয়কাড়া। দ্বিনের প্রতি তাদের আবেগ ও আকুতির কথা শুনলে যেকোনো মুমিনের চোখে পানি আসবে। তাদের সঙ্গে মিশলে বোঝা যায়, বাইরের জীবন থেকে তাদের ভেতরের জীবন কতটা ভিন্ন। আপনি জেনে অবাক হবেন তৃতীয় লিঙ্গের কেউ কেউ হজও করেছে’—বলেন মাওলানা হাবিবুর রহমান।</p> <p>আয়োজকদের থেকে প্রাপ্ত একটি ভিডিও ক্লিপে তৃতীয় লিঙ্গের হাফিজুর রহমান (অশ্রুমণি)-কে বলতে দেখা যায় ‘এটা প্রথমবার, আমরা ছোট করে করলাম। আপনাদের ভয় ভাঙল, আমাদেরও ভয় ভাঙল। সামনে এটা (দ্বিনি প্রশিক্ষণ) আরো বড় আয়োজনে করব।’</p> <p>অংশগ্রহণকারীদের সর্দার রাকিবুল ইসলাম (রাখি ম্যাডাম)-কে উদ্ধৃত করে আয়োজকরা বলেন, ‘তারা ধর্মপালনের অধিকার চায়। ধর্মীয় আচার ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে তাদের দূরে রাখায় তারা মানসিক কষ্টে ভোগেন। যেমন, পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের লাশ গ্রহণ না করা, তাদের জানাজা পড়াতে না চাওয়া, মসজিদ ও ঈদগাহে তাদের সামাজিক প্রবেশাধিকার না থাকা ইত্যাদি। এমনকি তাদের জন্য অনেক সময় তাদের পরিবারও সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হয়।</p> <p>তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকদের দ্বিন শেখার উদ্যোগ, আয়োজন ও সাধারণ সুযোগ না থাকায়ও হতাশা প্রকাশ করেন প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের কেউ কেউ। দ্বিনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ও দাবি; সর্বোপরি ঈমানি দায়িত্ববোধ থেকে মাওলানা হাবিবুর রহমান ও তার সহকর্মীরা সারা দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভেতর দ্বিনি শিক্ষা প্রসারে কাজ করতে চান এবং সুযোগ হলে তাদের জন্য বিশেষ মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা।</p> <p> </p>