<p>আমরা মনে করি, শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত আদায় করলেই জান্নাতে যাওয়া যায়। বিষয়টি আসলে এমন নয়। এ ছাড়া আরো কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমরা খুব হালকা মনে করি, অথচ এ বিষয়গুলোই মানুষের জান্নাতে যেতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এবং এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা অর্জন করা যাবে।</p> <p>রাসুল (সা.) তাঁর প্রিয় উম্মতকে এমন চারটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন, যেগুলোকে গুরুত্ব দিলে সেই উম্মত উভয় জাহানের সফলতা অর্জন করতে পারবে :</p> <p> </p> <p>আমনত রক্ষা করা : ‘হিফজু আমানাতিন’ অর্থাৎ বান্দার মধ্যে যার ওপর আমার হক আছে তা আমানতের সঙ্গে আদায় করা। আমানতের ব্যাপারে কারো সঙ্গে প্রতারণা না করা। কারো আমানত নিজের কাছে থাকলে তা তার কাছে যথাযথ পৌঁছে দেওয়া।</p> <p> </p> <p>সত্য কথা : ‘সিদকু হাদিছিন’ অর্থাৎ সর্বদা সত্য কথা বলা। মুখ থেকে যেন কোনো মিথ্যা অবাস্তব, এবং ধোঁকাবাজির কথা বের না হয়।</p> <p> </p> <p>উত্তম চরিত্র : ‘হুছনু খালিক্বাতিন’, সর্বোচ্চ উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ যে চরিত্র দেখলে আল্লাহও খুশি, বান্দাও খুশি হয়।</p> <p> </p> <p>হালাল রিজিক : ‘রিজকে হালাল’ উপায়ে রিজিক অন্বেষণ করা, অর্থাৎ হালাল উপায়ে রিজিক উপার্জন করা।</p> <p>রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মত যদি আমার থেকে এই চারটি জিনিস নিতে পারে, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাত তার হাতের মুঠোয় এসে পড়বে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৬৫২)</p> <p>এখন দেখার বিষয় হলো, এই চারটি জিনিসের মধ্যে আল্লাহর রাসুল ঠিকভাবে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, জাকাত দেওয়া—এগুলো কিছুই বলেননি।</p> <p>আমানতের ব্যাপারে ধোঁকাবাজি আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। কারো কাছে কোনো জিনিস আমানত রাখতে গেলে মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত সমাজেও এক লাখ টাকা আমানত রাখার জন্য একজন বিশ্বস্ত লোক খুঁজে পাওয়া যায় না, যে তার আমানতটা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করবে। আমি শুনেছি এবং আমি জানিও, অনেক মুসলমান ভাই শেষ পর্যন্ত আমানত অমুসলিমের কাছে রাখে। এবং সে বলে, এই অমুসলিমের কাছে আমি আমার আমানত যেভাবে রাখব, সে ওভাবেই ফেরত দেবে। এর বিপরীতে মুসলমানের কাছে রাখলে বলে, এই টাকা আর পাওয়া সম্ভব না। ‘লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা মিল্লাহ।’</p> <p>অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিশ্বস্ত লোকজন খোঁজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন অমুসলিম রাখতে হয়। কারণ সে কোনো মুসলিম বিশ্বস্ত লোক খুঁজে পাচ্ছিল না।</p> <p>মুসলমানদের এই আমানত কোথায় চলে গেল? এ কারণেই আল্লাহ তাআলা আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, যখন আমরা ইসলামের চিত্র পাল্টে ফেলব,  ইসলামী পদ্ধতি পাল্টে ফেলব, সঠিকভাবে লেনদেন করব না, ইসলামী মুয়াশারাত (সামাজিকতা) থাকবে না—এগুলো যখন আমরা সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলব, তখন আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তিনি আমাদের বিধর্মীদের দ্বারা শাস্তি দেবেন। আজ মুসলমানরা সত্যিই বিধর্মীদের হাতে মার খাচ্ছে। এর কারণ আমরা নিজেরাই বিধর্মীদের কাজ করছি। আমানতের খেয়ানত করছি। অথচ এগুলো মুসলমানদের কাজ নয়।</p> <p>রাসুল (সা.) একদিন হঠাৎ করে মদিনার বাজারে ছুটলেন। এক লোক গম বিক্রি করছিল খোলা বস্তায়, রাসুল (সা.) গিয়ে তাতে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। হাত বের করে দেখলেন হাত ভিজে গেছে। রাসুল (সা.) বুঝলেন ওপরের গম শুকনো আর ভেতরেরগুলো ভিজা। রাসুল (সা,) জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তুমি এই কাজ করলে? বিক্রেতা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! কালকে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। রাসুল (সা.) বলেন, তুমি ভেতরেরগুলো ওপরে না রেখে ভেতরে কেন রাখলে? এবং বলেন, যে ধোঁকাবাজি করবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসলিম, হাদিস : ১০২)</p> <p>খেয়াল করবেন, রাসুল (সা.) এই কথা বলেননি, যে নামাজ পড়বে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। রোজা না রাখলে  আমার উম্মত নয়। বরং বলেছেন, যে ধোঁকাবাজি করবে সে আমার উম্মত নয়। আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। যেখানে রাসুল (সা.)-এর উম্মত হওয়ার জন্য অন্য নবীরা ইচ্ছুক, সেখানে উম্মত হওয়ার পরও উম্মতের থেকে বের হয়ে যেতে হবে এই ধোঁকাবাজির কারণে।</p> <p>এটার নাম হচ্ছে ‘হুকুকুল ইবাদ’। ইসলামের শিক্ষা হলো, আল্লাহর হকও আদায় করতে হবে, বান্দার হকও আদায় করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর হকের চেয়ে বান্দার হকের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে অনেক গুণ বেশি। কেননা আল্লাহর হকে ভুলত্রুটি হলে আল্লাহ দয়ালু। যদি আমরা আল্লাহর কছে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাই, আল্লাহ মাফ করে দেবেন। কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করলে আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি তুমি বান্দার হক, মাখলুকের হক নষ্ট করো, তাহলে তা আমি ক্ষমা করব না। এটা যার হক সে ক্ষমা করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা ক্ষমা করবে না, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করবেন না। এ জন্য সবার কাছে অনুরোধ, আল্লাহর হক তো অবশ্যই আদায় করবেন, পাশাপাশি বান্দার হকের ব্যাপারেও উদাসীন হওয়া চলবে না। ক্ষমতা আছে, আপনি ঘরের বড় বা প্রধান। ভাই-বোনের হক আদায় করছেন না। বোনদের হক আদায় করছেন না। জিজ্ঞাসা করলে বলেন যে তারা নেয় না। নেবে না কেন? এই রকম বান্দার হক আদায় না করে তাহাজ্জুদ পড়ে বেড়ালে তাহাজ্জুদও কবুল হবে না। হুকুকুল ইবাদ এতই কঠিন। আমরা হুকুকুল ইবাদের ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন। আল্লাহ পাক আমাদের বোঝার তাওফিক দেন। আল্লাহর হকের ব্যাপারে যে রকম যত্নশীল, বান্দার হকের ব্যাপারেও আমাদের যত্নশীল হতে হবে। স্ত্রীর ওপর স্বামীর হক, স্বামীর ওপর স্ত্রীর হক, বাবার ওপর সন্তানের হক, সন্তানের ওপর বাবার হক, আমার ওপর আত্মীয়ের হক, আত্মীয়ের ওপর আমার হক। বাঁচা যাবে না এখানে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তুমি পেট ভরে খেয়ে ঘুমালে আর তোমার প্রতিবেশী অনাহার অবস্থায় রাতে ঘুমাল। আল্লাহর কসম, তুমি পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না। এগুলোতে আমাদের কোনো খবরই নেই। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, বান্দার হকের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে। কিয়ামতের ময়দানে নেকির পাহাড় নিয়ে আসবে এক ব্যক্তি, কিন্তু পাওনাদারদের পাওনা মেটাতে গিয়ে তার নেকি শেষ হয়ে যাবে তবু পাওনাদারদের পাওনা শেষ হবে না। তখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলবেন, পাওনাদারদের গুনাহ এই ব্যক্তির মাথায় চাপিয়ে দাও। শেষ পর্যন্ত পাওনাদারদের গুনাহ এর কারণে ওই ব্যক্তি পাহাড় পরিমাণ নেকির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।</p> <p>আল্লাহ তাআলা আমাদের বান্দার হক বোঝার এবং পূর্ণ করার তাওফিক দান করুন। এবং চেষ্টা করব, যাতে কারো হক আমার জিম্মায় না থাকে। পরিশোধ করতে না পারলে মাফ চেয়ে নেব। শুধু আর্থিক হক নয়, বরং কারো সমালোচনা করা বা গিবত করাও তার হক নষ্ট করার নামান্তর। গিবত-সমালোচনা এত মারাত্মক কেন? কারণ এই যে বান্দার অগোচরে তাকে নিয়ে গিবত করা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা এই বিষয় মাফ করবে না, আল্লাহও এই বিষয়ে মাফ করবেন না।</p> <p>এ জন্য সমালোচনার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। বিশেষ করে মৃত মানুষদের নিয়ে সমালোচনা করা বেশি জঘন্য। আফসোসের বিষয়, অনেক সুশিক্ষিত ও জনপ্রতিনিধিরাও মৃত মানুষের সমালোচনা করে বসে। এটা গর্হিত কাজ।</p> <p>জীবিতদের সমালোচনা করলে তো আল্লাহর ভয়, আসলে একসময় মাফ চেয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু মৃতদের ব্যাপারে কিভাবে কী করবেন। তাই মৃতদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে হুঁশিয়ার। আল্লাহ তাআলা আমাদের উল্লিখিত বিষয়গুলো বোঝা ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p>অনুলিখন : মুফতি বেলাল রহমানী</p>