<p>র‌্যাগিং, বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রচলিত এমন একটি ‘পরিচিতি বা দীক্ষা পর্ব’, যার মূল লক্ষ্যই থাকে প্রবীণ শিক্ষার্থী কর্তৃক নবীন শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা। প্রথম পরিচয়েই সিনিয়ররা তাদের জুনিয়রদের বুঝিয়ে দিতে চায়, তারা কতটা খারাপ ও প্রভাবশালী।</p> <p>যারা এভাবে জোর করে মানুষ থেকে সম্মান আদায় করতে চায়, রাসুল (সা.)-এর ভাষায় তাদের নিকৃষ্ট মানুষ বলা হয়েছে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি বললেন, তাকে অনুমতি দাও। সে তার বংশের নিকৃষ্ট সন্তান। অথবা বললেন, সে তার গোত্রের ঘৃণ্যতম ভাই। যখন সে প্রবেশ করল, তখন তিনি তার সঙ্গে নম্রভাবে কথাবার্তা বললেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এর ব্যাপারে যা বলার তা বলেছেন। এখন আপনি তার সঙ্গে নম্রভাবে কথা বললেন। তিনি বললেন, হে আয়েশা! আল্লাহর কাছে মর্যাদায় নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যার অশালীন ব্যবহার থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ তার সংসর্গ বর্জন করে চলে। (বুখারি, হাদিস : ৬১৩১)</p> <p>এই নিকৃষ্ট মানুষরা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অন্যদের মা-বাবা কিংবা জেলা তুলে গালি দেওয়া, বিভিন্ন অপমানজনক বা দুঃসাহসী কাজ করতে বাধ্য করা। (যেমন—সিনিয়র কাউকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া, শীতের রাতে পুকুরে নেমে গোসল করে আসা ইত্যাদি) কখনো কখনো গায়ে হাত তোলার মতো কাজও করেন।</p> <p>এই ভাইরাসটি শুধু আমাদের দেশেই প্রচলিত নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। শুধু নাম ভিন্ন হতে পারে। উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে একে বলা হয় ‘হেজিং’, ফ্রান্সে ‘বিজুটাহে’, পর্তুগালে ‘প্রায়ে’, অস্ট্রেলিয়ায় ‘বাস্টার্ডাইজেশন’ ইত্যাদি।</p> <p>ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম বা অষ্টম শতক থেকেই র‌্যাগিংয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান। একসময় ক্রীড়া সম্প্রদায়ে নতুন খেলোয়াড় বা শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটলে, তার ভেতর কতটুকু একতা রয়েছে তা ঝালাই করে নিতে এবং তার মধ্যে ‘টিম স্পিরিট’-এর বীজ বপন করে দিতে প্রবীণরা মিলে তাকে নানাভাবে উপহাস করত, তার নানা পরীক্ষা নিত, তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি যাচাই করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় অনেক পরিবর্তন আসে। একপর্যায়ে সৈন্যদলগুলো এই পদ্ধতিটি অনুসরণ শুরু করে, যেখান থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এটির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।</p> <p>কিছু পরিবারে নতুন বউয়ের ধৈর্য পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন উসকানিমূলক কথা বলা হয়, কঠিন কঠিন কাজ করানো হয়, আমাদের সমাজে এটিকে র‌্যাগিং না বললেও এটি র‌্যাগিংয়ের চেয়ে কম নয়।</p> <p>ইসলামের দৃষ্টিতে র‌্যাগিং অত্যন্ত মারাত্মক অপরাধ। কোনো মুসলমান এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার জিব ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৯৯৫)</p> <p>কিন্তু যারা র‌্যাগিং করে, তাদের এই দুটি অঙ্গই অন্যদের বেশি বিপদের কারণ হয়। সামান্য অজুহাতেই তারা অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মান নিয়ে খেলতে শুরু করে। তাদের বিভিন্ন মন্দ নামে ডাকে। আধিপত্য বিস্তার করতে সারাক্ষণ অন্যদের দোষত্রুটি তালাশে মগ্ন থাকে।</p> <p>অথচ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা কোরো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তওবা করে না, তারাই তো জালিম। (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১১)</p> <p>তাই প্রভাব বিস্তারের জন্য অন্যদের র‌্যাগিং না করে সবাই মিলেমিশে ভাই ভাই হয়ে থাকা উচিত। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কারো প্রতি (খারাপ) ধারণা থেকে বিরত থাকো। কেননা কারো প্রতি (খারাপ) ধারণা করা, সবচেয়ে বড় মিথ্যা। তোমরা অন্যের দোষ অন্বেষণ কোরো না, গোয়েন্দাগিরি কোরো না, পরস্পর হিংসা কোরো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ কোরো না এবং পরস্পর বিরোধে লিপ্ত হয়ো না। বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে থেকো।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর : ৬০৬৪)</p> <p>আমার কাছে মনে হয়, সমাজ থেকে র‌্যাগিং দূর করার জন্য রাসুল (সা.)-এর এই বাণীটিই যথেষ্ট। যাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, কোরআন-হাদিসের জ্ঞান আছে, তারা কখনো এ ধরনের কাজ করবে না। একমাত্র আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে সব অপকর্ম থেকে বিরত রেখে আলোর পথ দেখাতে। তাই র‌্যাগিং বন্ধে যুবসমাজের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তারা যখন নৈতিক শিক্ষা পাবে, তখন সমাজে অপরাধ অনেকাংশেই কমে যাবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন।</p> <p> </p>