<p>প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের বেশির ভাগ নাগরিকই গোত্রীয় আইন ও রীতিনীতি ছাড়া অন্য কিছু মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিল না। তাদের প্রিয় বস্তু ছিল তিনটি—মদ, নারী ও যুদ্ধ। গোত্রে গোত্রে, পরিবারে পরিবারে একবার যুদ্ধ বেধে গেলে কয়েক পুরুষ পর্যন্ত চলত। বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য অনেক সময় রক্তের স্রোত প্রবাহে আনন্দ লাভ করত। এসব যুদ্ধ সংঘটনের অন্যতম কারণ ছিল অর্থাভাব, জীবিকার স্বল্পতা এবং শৃঙ্খলা ও ঐক্যের অনুপস্থিতি। যেহেতু যুদ্ধে অর্জিত সম্পদ তাদের অন্যতম উপজীবিকা, তাই শিশুকাল থেকেই তাদের অশ্ব পরিচালনা, শত্রুদের আক্রমণ এবং দ্রুতবেগে পলায়ন—এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হতো। এ ছাড়া তীর-ধনুক, তরবারি ও বর্শা চালনায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।</p> <p> </p> <p><strong>ইসলামপূর্ব যুগে আরবদের সমরকৌশল   প্রাচীন আরবে সামরিক কৌশল সম্পর্কে দুটি পদ্ধতির কথা জানা যায়। </strong></p> <p>প্রথম পদ্ধতি : এ পদ্ধতি আল-কার ওয়া আল-ফার, যথাক্রমে আক্রমণ ও পলায়ন কৌশল হিসেবে অভিহিত। আধুনিক সামরিক পরিভাষায় যাকে গেরিলা যুদ্ধ বলা হয়। কোনো কোনো সময় নিয়মিত যুদ্ধের সম্মুখীন হলে সাধারণত তারা রসদপত্রের বাহন কিংবা ক্ষুদ্র অংশের ওপর রাত্রিকালে আক্রমণ করত। এতে উদ্দেশ্যও সফল হতো এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হতো। আরবের লোকরা শুধু দেশের ভেতরই এ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করত না, আরব সীমান্তবর্তী সিরিয়া, মিসর ইত্যাদি অঞ্চলেও একই পদ্ধতিতে আক্রমণ পরিচালনা করে ধন-সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে আসত।</p> <p>দ্বিতীয় পদ্ধতি : যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটি বড় ও দীর্ঘস্থায়ী। সেনাবাহিনীকে পাঁচ ভাগ করা হতো। তা হলো, আল-কালব (কেন্দ্র), আল-মাইমানা (দক্ষিণ বাহু), আল-মাইসারা (বাম বাহু), আল মুকাদ্দিমা (অগ্রভাগ) ও আল-সিকা (পশ্চাদরক্ষী)। এ পদ্ধতিটিকে খামিস (পাঁচ) হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।</p> <p><strong>আরবদের যুদ্ধপ্রীতি</strong></p> <p>যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকা দিনগুলোকে ‘আইয়াম আল-আরব’ (আরবের যুগ) বলা হতো। (History of Arabs, P. 87-89; সিরাতে মুস্তফা, পৃষ্ঠা ৫৬; সিরাতুন্নবী : ৪/২৬৮)</p> <p>তাগলিক গোত্র ও বকর গোত্রের দাহিস নামে এক ঘোড়া যুবিয়ান গোত্রের আল-গাব্বা নামক এক উটের মধ্যে প্রতিযোগিতায় যুবিয়ানদের অনিয়মের আশ্রয়কে কেন্দ্র করে কয়েক দশক ধরে এ যুদ্ধ চলতে থাকে। বিখ্যাত মুয়াল্লাকা কবি আনতারা বিন শাদদাদ আল-আবশির হস্তক্ষেপের ফলে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। (সিরাতে মুস্তফা, পৃষ্ঠা ৫৭ ও ৫৮; কিতাব আল আগানি : ৪/১৪০-১৫২; History of Arabs, P. 82.)</p> <p>কুরাইশ ও হাওয়জিন গোত্রের মধ্যে এক যুদ্ধ পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল। যুদ্ধটি হারাম মাসে শুরু হয়েছিল বলে একে ফুজ্জার (গর্হিত) যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়। আর একটি যুদ্ধ হয়েছিল মদিনার আউস এবং খাজরাজ গোত্রের মধ্যে। মহানবী (সা.)-এর মদিনা সনদের ফলে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/01.January/04-01-2020/121/3_kalerkantho-2019-3-pic-1.jpg" style="height:483px; margin:12px; width:800px" /></p> <p><strong>যুদ্ধে নারী ও আরবসমাজ</strong></p> <p>অনেক সময় এসব যুদ্ধে নারীরাও অংশগ্রহণ করত। আর এ নিকলসন বলেন, বানু বকর ও বানু তাগলিব গোত্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। নারীরা বিভিন্ন প্রকারের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এবং কবিরা কবিতার সাহায্যে নিজ গোত্রের শৌর্য-বীর্যের গুণকীর্তন করে উৎসাহ দিতেন, আর প্রতিপক্ষ গোত্রের কুৎসা রটনা করে নিরুৎসাহ করতেন। (A Literary History of Arabs, P. 55-60, Bharagava; A Survey of  Islamic Culture and Institution (Alahabad : 1961) P. 09)|</p> <p><strong>সম্মান ও জীবিকার জন্য যুদ্ধ</strong></p> <p>গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, গৌরব বৃদ্ধির অভিলাষ, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি ছিল যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আরবের বিখ্যাত কবিদের কবিতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কায়েস ইবনে সালার, আমর ইবনে কুলসুম, কবি তুরাফা, হাজার ইবনে খালিদ সালাবি প্রমুখের কবিতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগে আরবের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বীর একে অপরকে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানাতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সমকক্ষ ও সমগোত্রীয় বীর ছাড়া অন্য বীরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে ঘৃণাবোধ করতেন। মল্লযুদ্ধের পরই সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ আরম্ভ হতো।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2020/01.January/04-01-2020/121/5_kalerkantho-2019-3-pic-1.jpg" style="height:483px; margin:12px; width:800px" /></p> <p><strong>আত্মরক্ষার আরবীয় কৌশল</strong></p> <p>আরবরা প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে ইয়েমেন, তায়েফ, হেরাসহ মদিনায় প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তারা কোথাও সুরক্ষিত দুর্গও নির্মাণ করে। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেনে ২০ তলা প্রাসাদ, হাদরা মউত, মাহরা ও ওমানেও সুরক্ষিত দুর্গ ছিল বলে জানা যায়। সমগ্র পেট্রা শহরের প্রাচীর দুর্গ প্রস্তর নির্মিত ছিল। হেরার কাছে প্রখ্যাত আল-খাওয়ার নামক প্রাসাদ অতিশয় মজবুত দুর্গের মতো করে তৈরি করা হয়। ঐতিহাসিক তাবারির মতে, হেরার অন্য একটি দুর্গের নাম ছিল সাদি। ইহুদি সামন্তরাজ ‘সামওয়াল’ পার্থিব যশ-খ্যাতি অর্জন ও বহিরাক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ‘তাইয়াল আবলক’ দুর্গ নির্মাণ করেন। শক্তিশালী ও বিত্তবান আরব গোত্রগুলো সংঘবদ্ধভাবে সুরক্ষিত এলাকায় বসবাস করত।</p> <p><strong>আরবের যুদ্ধাস্ত্র</strong></p> <p>যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে আরবরা সাধারণত তীর, ধনুক, বর্শা, বল্লম ও ঢাল ব্যবহার করত। একজন সাধারণ যোদ্ধা প্রচলিত নিজস্ব অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করত। আর অর্থশালী ও বিত্তবান ব্যক্তিরা যুদ্ধে বর্ম বা শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করত। যুদ্ধের বাহন ছিল ঘোড়া বা উট। প্রাচীনকালে ঘোড়ার তেমন আমদানি না থাকলেও তারা এ দুর্লভ জন্তুকে ‘আল-কার ওয়া আল-ফার’ পদ্ধতির গেরিলা যুদ্ধে ব্যবহার করত। প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র ও ড্রাম পিটিয়ে তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো এবং স্বগোত্রীয় প্রশংসাসূচক রণসংগীত গেয়ে সেনাদের উত্তেজিত করত। প্রত্যেক গোত্রের নিজস্ব পতাকা ছিল গোত্রীয় মান-মর্যাদার প্রতীক। ঝাণ্ডাবাহী সৈনিকদের বৈশিষ্ট্য মর্যাদার চোখে দেখা হতো। [আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল ফকিহ আল হামদানি, কিতাবুল বুলদান, (লাইডেন, খ্রি. ১৮৮৫) পৃ. ১৭৮]</p> <p><strong>মহানবী (সা.)-এর সমরনীতি</strong></p> <p>মহানবী (সা.) যখন ইসলামের বাণী প্রচার আরম্ভ করেন তখন যুদ্ধবিগ্রহ ছিল সমাজের সাধারণ নিয়ম। মহানবী (সা.) যুদ্ধকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করে বরং আক্রমণ প্রতিহত ও অত্যাচারীর অত্যাচার থেকে নিপীড়িত মানুষকে উদ্ধারের মধ্যে যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ রাখেন। এ ছাড়া নানা শর্ত, অঙ্গীকার ও আইনের দ্বারা যুদ্ধকে সীমিত করেন। সর্বোপরি যুদ্ধরত পক্ষগুলো কী কী নিয়ম ও শিষ্টাচার পালন করবে তাও মহানবী (সা.) নির্দিষ্ট করে দেন। ইসলামী সমরনীতিতে যুদ্ধকে সীমিত করা হয়েছে। সর্বোপরি যুদ্ধরত শত্রুর প্রতি মানবাধিকার প্রদর্শন একটি ন্যায়বিচার ও উদার নীতিমালা হিসেবে আজ আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। নিম্নে মহানবী (সা.) প্রণীত ইসলামী সমরনীতির একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো।</p> <p>১.   যুদ্ধ করার আগে শত্রুকে ইসলাম গ্রহণ অথবা বশ্যতা স্বীকার করে জিজিয়া (নিরাপত্তা কর) প্রদানে আহ্বান জানাতে হবে। কিছুতেই ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না।</p> <p>২.   শুধু শান্তিপূর্ণ ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বল প্রয়োগ বৈধ। যদি শত্রুপক্ষ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকে, তবে তাদের ওপর অত্যাচার বা কোনো প্রকার অস্ত্র প্রয়োগ বৈধ নয়।</p> <p>৩.   যুদ্ধরত কোনো আশ্রয়প্রার্থী অবিশ্বাসী শত্রুকেও হত্যা করা যাবে না; বরং সে একজন মুসলিমের মতোই নিরাপত্তা পাবে। যুদ্ধরত অবস্থায় কোনো সৈনিক মুখে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলে, সন্দেহ করে তাকে হত্যা করা চলবে না। বরং সে একজন মুসলমানের মর্যাদা লাভ করবে।</p> <p>৪.   পরাজিত শত্রুকে বন্দি করতে হবে। বন্দিদের দয়া প্রদর্শন অথবা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দান করা বৈধ।</p> <p>৫.   শত্রুপক্ষ থেকে শান্তির আভাস পাওয়া গেলে যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। অবিশ্বাসী সম্প্রদায় শান্তির প্রতি আকৃষ্ট হলে তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদনে আগ্রহী হওয়া বাঞ্ছনীয়। কপট শান্তি প্রস্তাবও গ্রহণ করা বৈধ। যত দিন তারা চুক্তির শর্ত বা শর্তাবলির প্রতি অবিচল থাকবে তত দিন মুসলমানেরও অবিচল থাকা উচিত।</p> <p>৬.   চুক্তি ভঙ্গকারী প্রতিপক্ষকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া বৈধ। চুক্তিবদ্ধ কোনো সম্প্রদায় প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা করলে সম্পাদিত চুক্তি সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল ঘোষণা করতে পারবে।</p> <p>৭.   অত্যাচার, ব্যভিচার, নিগ্রহ-নিপীড়ন প্রতিরোধ, সীমালঙ্ঘন ও আল্লাহদ্রোহীদের দমন, আপন প্রাণ, স্বীয় বংশ, ধন-সম্পদ, মাতৃভূমি ও দ্বিনের পূর্ণ সংরক্ষণের জন্য যুদ্ধ বৈধ।</p> <p>৮.   মুসলমানের পক্ষ থেকে যুদ্ধকে কখনো কোনো ক্রমেই ধোঁকা বা বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যম বানানো যাবে না। তবে যুদ্ধের গতি বৃদ্ধি বা আত্মরক্ষার জন্য পিছু সরে আসতে পারে। এরূপ ধোঁকা প্রদান ইসলামে বৈধ। আর যদি যুদ্ধ অনিবার্য হয় তাহলে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের ঘোষণার কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে। এ ঘোষণাকে আধুনিক যুদ্ধ পদ্ধতির চরমপত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়।</p> <p>৯.   যুদ্ধ ও সন্ধি উভয় ক্ষেত্রেই সর্বপ্রকার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। এমনকি প্রতিপক্ষ সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করলেও ইসলাম মুসলমানের চুক্তি ভঙ্গের অনুমতি দেয়নি।</p> <p>১০. বেসামরিক জনগণ যেমন—নারী, শিশু, রোগী, আহত, অন্ধ, পঙ্গু, উন্মাদ, পর্যটক, খানকায় (উপাসনালয়) ইবাদতকারী, মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য উপাসনালয়ের সেবক, শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ীকে হত্যা সম্পূর্ণ অবৈধ।</p> <p>১১. ধন-সম্পদ, দালানকোঠা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস করা ইসলামে সম্পূর্ণ বেআইনি। মহানবী (সা.) মদিনার উপকণ্ঠে বসবাসকারী বনু-নাজিরকে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন বটে, কিন্তু তাদের ধন-সম্পদ ও ফলের গাছ জ্বালিয়ে দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন।</p> <p>১২. জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যথা—খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র এবং কাপড়চোপড়ের সরবরাহ বন্ধ করে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা অবৈধ। আবু সুমাতা ইবন আমাল কুরাইশদের সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ ঘটনা শুনে মহানবী (সা.) সরবরাহের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।</p> <p>যুদ্ধ-সম্পর্কিত ইসলামের এ নীতিমালা মানবতা ও মহানুভবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক সমরনীতিতে এর অনেকই অনুপস্থিত। বর্তমানে বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনী বোমা ও গোলাবর্ষণ করে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা ও নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে থাকে। যা ইসলামী সমরনীতিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাইকারি হারে বোমা বর্ষণের ফলে লাখ লাখ সাধারণ লোকের মৃত্যু হয়, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।</p> <p>আধুনিক যুদ্ধপদ্ধতি বড় নিষ্ঠুর ও নির্মম। সেনাবাহিনী পশ্চাদ্পসরণের সময় পোড়ামাটি-নীতি অনুসরণ করে থাকে। এ যুগে মহানবী (সা.) অনুসৃত নীতিমালা অনুসরণ করলে পৃথিবী যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেত। জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, I beleive that if a man like him were to assume the dictatorship of the modern world he would succeed in solving its problems in a way that would bring the much-needed peace and happiness. মহানবী (সা.)-এর সামরিক অভিযানের প্রকৃতি মহানবী (সা.)-এর যুদ্ধাভিযানের প্রকৃতি ঐতিহাসিকরা বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলায় লেখা ইসলামের ইতিহাসের বইগুলো মূলত ইংরেজি ভাষায় লেখা বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লেখা। বেশির ভাগ ইউরোপীয় লেখক প্রমাণ করতে চেয়েছেন, ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে রক্তপাত, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জোরজবরদস্তি করে। মহানবী (সা.)-এর প্রতিটি যুদ্ধই ছিল আক্রমণাত্মক। তাদের পরিবেশিত তথ্য যে সত্য নয় তা মহানবী (সা.)-এর গাজওয়াহ ও সারিয়্যার প্রকৃতি পর্যালোচনা থেকে প্রমাণিত হয়।</p> <p>মহানবী (সা.) হিজরতের ১৮ মাসের মধ্যে মদিনার চারপাশে সাতটি অভিযান পরিচালনা করেন। হামজাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.)-এর অধিনায়কত্বে পরিচালিত সারিয়্যাটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সারিয়্যা (রমজান, প্রথম হি./এপ্রিল ৬২৩ খ্রি.) হিসেবে আখ্যায়িত। এখানে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের একটি ভুল ধারণা যে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা অবরোধ করার জন্য এ অভিযান প্রেরণ করা হয়েছিল। এ ধারণা ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে তা ছিল জুহায়না গোত্রের এলাকা আর তারা ছিল খাজরাজ গোত্রের হালিফ বা মিত্র আর মুজায়না গোত্র ছিল আউস গোত্রের মিত্র। মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর খাজরাজ ও জুহায়না এবং আউস ও মুজায়নার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। মহানবী (সা.) মদিনায় আগমনের প্রথম থেকেই বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে জোট গঠন করার চিন্তা করছিলেন। অতএব কুরাইশ কাফেলাকে বাধা দেওয়ার চেয়ে জুহায়নার সমর্থন নিশ্চিত করাই ছিল হামজাহ (রা.)-এর অভিযানের প্রধান লক্ষ্য।</p> <p>দ্বিতীয় সারিয়্যাটি (শাওয়াল, প্রথম হি./এপ্রিল, ৬৩২ খ্রি.) উবায়দা ইবনে হারিস (রা.)-এর নেতৃত্বে মদিনা থেকে ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে লোহিত সাগরের উপকূলে রাবিগ নামক স্থানে প্রেরণ করা হয়েছিল। এটি কুরাইশ কাফেলার বিরুদ্ধে পাঠানো হয়নি। কেননা কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলায় অনূর্ধ্ব ২০০ নিরাপত্তারক্ষী ছিল। আর উবায়দা ইবনে হারিস (রা.)-এর বাহিনীতে ৬০ জনের বেশি সৈন্য ছিল না। এত অল্পসংখ্যক সদস্য নিয়ে একটা বিরাট বাহিনীর মোকাবেলা কোনো প্রকারে সম্ভব নয়, তা সহজে অনুমেয়। যদিও ঐতিহাসিকরা (ড. মোহাম্মদ হুসাইন হাইকল) উল্লেখ করেছেন যে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) শত্রুর দিকে একটি তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রকৃত কারণ হতে পারে না।</p> <p>সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে যে অভিযান (জিলকদ, প্রথম হি./মে. ৬২৩ খ্রি.) প্রেরণ করা হয়েছিল, তা নিছক টহলদার হিসেবে পাঠানো হয়।</p> <p>মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে আবওয়া বা ওয়াদ্দান, বুওয়াত, সাফওয়ান এবং উশায়রা মোট চারটি গাজওয়া পরিচালিত হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রতীয়মান হয়, এসব অভিযান কুরাইশ কাফেলাকে আক্রমণ করার জন্য প্রেরণ করা হয়নি বরং তথ্য সংগ্রহ এবং মদিনার পার্শ্ববর্তী গোত্রগুলোর মধ্যে মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলাম রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করা হয়েছিল। বনু মুদলিজ, বানু জামুরা, গিফার, আসলাম, মুজায়না, জুহায়না ও অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর বন্ধুত্ব স্থাপন ও শান্তিচুক্তি সম্পাদন প্রমাণ হিসেবে কাজ করছে।</p> <p>মুসলিম বাহিনী ও কুরাইশ বাহিনীর শক্তির মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান ছিল, কখনো কখনো কুরাইশ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা মুসলমানদের সংখ্যার চেয়ে দশ গুণের বেশি ছিল। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে তুলনামূলকভাবে অনেক কমসংখ্যক বাহিনী নিয়ে কুরাইশ বাণিজ্যিক কাফেলাকে হামলা করা মুসলিম বাহিনীর অভিযানের লক্ষ্য হতে পারে না। মদিনার পশ্চিমে ৪৫ কিলোমিটার থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত গোত্রগুলোর ওপর মুসলমানের ঈমানী সাহস ও শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই মহানবী (সা.) উল্লিখিত চারটি অভিযান শেষে শত্রুদের স্থানে কিছুদিন অবস্থান করেন। মুসলিম বাহিনী ও মহানবী (সা.)-এর প্রাথমিক অভিযানগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মদিনা থেকে অভিযানের স্থলগুলো মক্কা ও সিরিয়ার মধ্যে অবস্থিত বাণিজ্য পথে ছিল না।</p> <p>ইসলামের প্রাথমিক যুগে মদিনায় মুসলমানের সৈন্য দল গঠন ও টহলদার বাহিনী পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের পথ পরিহার করে সমঝোতায় আসতে কুরাইশদের দৃষ্টি আকর্ষণ। মদিনায় হিজরত করার পর মহানবী (সা.) মক্কার কুরাইশদের হিংসা ও শত্রুতার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। এ জন্য তারা মদিনার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে এক চিঠিতে মহানবী (সা.)-কে হত্যা কিংবা মদিনা থেকে বের করে দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করে, অন্যথায় মদিনা আক্রমণের হুমকি দেয়। উল্লেখ্য, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই প্রখ্যাত ইহুদি নেতা হিসেবে মদিনার সিংহাসনে আরোহণ করার কথা ছিল।</p> <p>মক্কার কুরাইশরা কাবাঘরের সেবক হওয়ার কারণে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। তাদের প্ররোচনায় মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পথে যেসব গোত্রে বসবাস করত অচিরেই তারা মুসলমানের শত্রুতে পরিণত হলো। এসব গোত্রের লোকেরা তাদের বাধা দেওয়ার কারণে রাসুল (সা.)-এর কাছে আসতে পারত না। সহিহ হাদিস গ্রন্থগুলোয় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদি এবং মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দল অতর্কিতে মুসলমানের আক্রমণ করতে পারে এ আশঙ্কায় মুসলিমরা আত্মরক্ষার জন্য শত্রুদের সম্ভাব্য আগমন পথে প্রয়োজনীয় সতর্ক থাকত। এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কুরাইশদের অহংকারী মনকে আরো আক্রমণাত্মক করে তোলে। তাদের হিংসাত্মক প্রতিশোধ গ্রহণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহানবী (সা.) হিজরতের পর পর আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বন করেন। এ ছাড়া কার্যত মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় বসবাসরত বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের চুক্তি স্বাক্ষর করাতে বাধ্য করাই ছিল এসব অভিযানের লক্ষ্য।</p> <p>আল-কোরআন বদর যুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। মুসলমানকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে কুরাইশদের অর্থ-অস্ত্র সংগ্রহের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে কাফিররা নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, যাতে তারা ইসলাম প্রচারে বাধা দান করতে পারে। বস্তুত তারা আরো ব্যয় করবে, অতঃপর তা তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হবে এবং পরিশেষে তারা পরাজিত হবে।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৩৬)</p> <p>উল্লিখিত আয়াতটির দুটি ক্রিয়াপদ দ্বারা বদরযুদ্ধের আগের ও পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, কাফিররা ইসলাম ধর্মকে প্রতিহত করার জন্য মুসলমানের বিরুদ্ধে তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করছে, দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে তারা গচ্ছিত ধন-সম্পদ এ কাজেই ব্যবহার করবে। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় বদরযুদ্ধের আগ থেকেই মুসলমান তথা ইসলামকে ধ্বংস করতে তারা প্রস্তুত হচ্ছিল আর মুসলমানরা আত্মরক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করেছে মাত্র।</p> <p>বদর সম্পর্কে কোরআনে আরো বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রভু তোমাকে ঘর থেকে ন্যায় ও সৎ কাজের জন্য বের করেছেন, অথচ মুসলমানের একটি দল এতে সম্মত ছিল না। সত্য ও ন্যায় স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হওয়ার পরও তারা তোমার সঙ্গে বাগিবতণ্ডা করছিল, যেন তারা দৃশ্যমান মৃত্যুর পানে ধাবিত হচ্ছে। আর যখন আল্লাহ দুটির (অবিশ্বাসীদের দুটি দল) একটি তোমাদের সঙ্গে অঙ্গীকার মোতাবেক তোমাদের হস্তগত হবে, আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে (যে দলে) কোনো রকম কণ্টক নেই, তোমাদের ভাগে আসুক অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং অবিশ্বাসীদের মূল কর্তন করে দিতে। যাতে সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা দিয়ে প্রতিপন্ন করে দেয়, যদিও পাপাত্মারা অসন্তুষ্ট হয়।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৫-৮)</p> <p>আলোচ্য আয়াতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়— </p> <p>ক. মুফাসসিররা (কোরআন বিশারদ) এ আয়াতটি বদরযুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।</p> <p>খ. মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশেই যাতে অত্যাচারিত ও উত্পীড়ত মুসলমানরা আর নির্যাতিত না হয়, তাই তাদেরকে রক্ষার জন্য অত্যাচারী, দাম্ভিক কাফিরদের বিরুদ্ধে বদর অভিযানের ব্যবস্থা করেন।</p> <p>গ. মদিনায় অবস্থানের সময় সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।</p> <p>ঘ. সাহবায়ে কেরামদের মধ্যে মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে পরামর্শ চলছিল, তখন কিছু সাহাবি মদিনার বাইরে যাত্রার পক্ষে মতামতে ভীত ও কুণ্ঠিত হন। মহানবী (সা.) এই প্রথম মদিনার বাইরে যুদ্ধ করার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।</p> <p>বিশ্বের বিভিন্ন বিপ্লব ও যুদ্ধবিগ্রহের হিসাব আমাদের সামনে রয়েছে। এর আলোকে মুহাম্মদ (সা.) শ্রেষ্ঠ আদর্শ ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজাতিকে জাগিয়ে তুলতে যে সংগ্রাম করেছেন নিঃসন্দেহে তাকে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিপ্লব বলা যায়। তিনিই সর্বপ্রথম একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বহু শতাব্দীর অপসংস্কৃতি, বৈষম্য আর নির্যাতনের স্থানে সর্বজনীন ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিহতদের সংখ্যা অন্যান্য বিপ্লব আর বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় খুবই নগণ্য। এতে প্রমাণিত হয়, অস্ত্রে নয়, বরং উদারতা, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ফলে ইসলাম প্রসার লাভ করে।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ</p> <p>চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।</p> <p> </p>