<p>আরবি ওয়াজ শব্দের বাংলা অর্থ সদুপদেশ। ইসলামী পরিভাষায় ওয়াজ হলো জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে এমনভাবে আহ্বান করা, যাতে তাদের অন্তর বিগলিত হয়। (তাফসিরুশ-শা’রাভি, পৃষ্ঠা ৬১৭৮, টীকা ১)</p> <p>কোরআনে আল্লাহ ওয়াজকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দান করেন, তা কতই না উত্তম। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৭)</p> <p>মুমিনের জীবনে ওয়াজ-নসিহত ও উপদেশের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য এসেছে উপদেশ ও তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তার আরোগ্য এবং মুমিনের জন্য হেদায়েত ও রহমত।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫৭)</p> <p>আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, উপদেশ, যা মানুষকে অশ্লীলতা থেকে ফিরিয়ে রাখে, সন্দেহ ও সংশয়মুক্ত করে, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে দূরে রাখে এবং যার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর পথ ও রহমত লাভ করে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)</p> <p>পরকালীন লাভ-ক্ষতির উল্লেখ করে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানের এই ধারা প্রথম মানব ও নবী আদম (আ.)-এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং পৃথিবীতে যত দিন ইসলামের অস্তিত্ব থাকবে তত দিন তা অব্যাহত থাকবে। কেননা দ্বিনের পথে আহ্বান জানানো মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনে নিজ নিজ জাতির প্রতি নবী (আ.)-দের দাওয়াতের যে চিত্র পাওয়া যায়, তার সঙ্গে সমকালীন ওয়াজ-নসিহতের খুব বেশি পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও ঈমান, ইখলাস, প্রজ্ঞা ও সততার দিক থেকে তাঁরা ছিলেন সাধারণ মানুষের অনেক ঊর্ধ্বে। নবী-রাসুল (আ.) জনসমাগমে গিয়ে যেমন ঈমান ও ইসলামের আহ্বান জানাতেন, তেমনি সাধারণ মানুষ ঐশী নির্দেশনা পেতে তাঁদের কাছে সমবেত হতো। এই দুটি ধারাই মুসলিম সমাজে বর্তমান। সে হিসেবে বলা যায়, ওয়াজ-নসিহত আম্বিয়া (আ.)-এর উত্তরাধিকার।</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের একাধিক দলকে বিভিন্ন গোত্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন ইসলামের প্রচার-প্রসার ও বিধি-বিধান শেখানোর জন্য। যে ধারা পরবর্তী সময়ে মুসলিম শাসকরাও অব্যাহত রাখেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘বক্তা’দের খতিব বলা হতো এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাঁদের জন্য বেতনও নির্ধারিত ছিল। তাঁরা মানুষকে ইসলামী বিধি-বিধান শেখানোর পাশাপাশি নিয়মিত উপদেশও দিতেন। ইসলামী খিলাফতভুক্ত নতুন অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামী সমাজ গঠনে তাঁদের ওয়াজ-নসিহত ও উপদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচারেও তা ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। ড. আহমদ হায়কাল বলেন, ‘বক্তৃতার আবশ্যকতা ছিল, যুদ্ধ ও আন্ত সম্প্রদায় বিরোধের প্রেক্ষাপটে। তার প্রয়োজন হতো রাজনৈতিক ও দ্বিনি নানা উপলক্ষে।...তারা কম হলেও সেসব ওয়ায়েজ ও ইসলাম প্রচারকের কথা গভীরভাবে শ্রবণ করত, যারা সাধারণ সৈন্যদের সঙ্গে থাকত এবং নতুন নতুন প্রদেশে যেত।’ (আল-আদবুল আন্দালুসি মিনাল ফাতহি ইলা সুকুতিল খিলাফাহ, পৃষ্ঠা ৬৬)</p> <p>উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফি-সাধকদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সুফি-সাধকদের ইসলাম প্রচার যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক ও জ্ঞানভিত্তিক ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ওয়াজ-নসিহত ও মানবসেবা কেন্দ্রিক। উপমহাদেশে মুসলিম শাসকদের আগমন এবং তাঁদের সহযোগিতায় জ্ঞানভিত্তিক ইসলামের বিশুদ্ধ চর্চা শুরু হওয়ার বহু আগে সুফি-সাধকরা তাঁদের ওয়াজ-নসিহত ও কল্যাণকামিতার মাধ্যমে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেন। তাঁদের অবদান সম্পর্কিত এক প্রবন্ধের শুরুতে মুহাম্মদ আল হাসানি (রহ.) বলেন, ‘ভারতবর্ষের ইসলাম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক মুরব্বিরা, যাঁদের সুফি বলা হয়। ইসলামের প্রচার, মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন গঠন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধ ও ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে তাঁদের অতুলনীয় অবদান ও প্রভাব তুলে ধরা আমার উদ্দেশ্য।’ (সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি, আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ, পৃষ্ঠা  ১৪৭)</p> <p>উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ওয়াজ এখনো প্রাসঙ্গিক। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষ, যারা সব ধরনের শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ থেকে বঞ্চিত, তাদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রধান অবলম্বন মসজিদের সাপ্তাহিক নসিহত ও বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল। এ ছাড়া পুতুলনাচ, যাত্রা ও পালাগানের মতো অনৈসমালিক উৎসব আয়োজনের বিপরীতে ওয়াজ মাহফিলের সাংস্কৃতিক মূল্যও কম নয়। তবে ধর্মীয় গাম্ভীর্য, পরকালীন কল্যাণ ও নিষ্ঠার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ওয়াজ মাহফিলের দেহে যে লৌকতার রং লাগছে, তা অবশ্যই বর্জনীয়। নতুবা এই দ্বিনি উত্তরাধিকার শুধু আবেদন হারাবে না, বরং তা নানা মহলে সমালোচিতও হবে।</p>