<p>আল্লাহ তাআলা মানবজাতির কল্যাণে নাজিল করেছেন কোরআন মজিদ। এতে রয়েছে উম্মতের সব সমস্যার সমাধান। উম্মতের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেছেন আল্লাহ তাআলা। কোরআন মজিদ মহানবী (সা.)-এর জীবনের ২৩ বছরে প্রয়োজনের চাহিদা অনুযায়ী নাজিল হয়। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখনই তার সমাধান অবতীর্ণ হয়। সাহাবায়ে কেরামের মনে কোনো কিছু জানার উদ্রেক হলে প্রিয় নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করতেন। রাসুল (সা.)-এর জানা থাকলে উত্তর দিতেন, অন্যথায় ওহির প্রতীক্ষায় থাকতেন। সাহাবায়ে কেরামের এ ধরনের ১৪টি প্রশ্নের উত্তর কোরআন মজিদে প্রদান করা হয়েছে।</p> <p> </p> <p>১. স্রষ্টার অবস্থান প্রসঙ্গে : এক দল লোক মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চায়, আল্লাহ কী আমাদের কাছে যে আমরা তাঁকে আস্তে ডাকব, নাকি জোরে আওয়াজ করে ডাকব? আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যুত্তরে ইরশাদ করেছেন, ‘আর যখন আমার বান্দারা আপনার কাছে আমার (অবস্থান) প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে, আপনি তাদের বলুন, আমি আছি (তাদের) সন্নিকটে। যারা আমাকে ডাকে, আমি তাদের ডাকে সারা দিই। ফলে তাদের একান্ত কর্তব্য আমার হুকুম মান্য করা এবং আমাকে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৬)</p> <p> </p> <p>২. নতুন চন্দ্র প্রসঙ্গে : মুয়াজ ইবনে জাবাল, সালাবা ইবন গানম প্রমুখ নতুন চন্দ্র প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করলে আল্লাহ তাআলা প্রত্যুত্তরে এই আয়াত নাজিল করেন, ‘তারা আপনাকে নতুন চন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি তাদের বলে দিন যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ (ক্যালেন্ডার) এবং হজের সময় ঠিক করার মাধ্যম।’ (সুরা : বাকারা : ১৮৯)।</p> <p> </p> <p>৩. ব্যয় করার খাত প্রসঙ্গে : আমর ইবনে জামুহ নামক এক ধনী ব্যক্তি প্রশ্ন করে, হে মুহাম্মদ (সা.), আমি কী বস্তু খরচ করব এবং কী বস্তু খরচ করব না! আল্লাহ তাআলা তার প্রত্যুত্তরে এ আয়াত নাজিল করেন, ‘আপনি তাদের বলে দিন, যে বস্তুই তোমরা ব্যয় করো, তা হবে মাতা-পিতার জন্য, নিকটাত্মীয়দের জন্য, এতিম-অনাথদের জন্য, নিঃস্ব-অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৫)</p> <p> </p> <p>৪. সম্মানিত মাস প্রসঙ্গে : মহানবী (সা.) কাফিরদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। অভিযানকারীরা কাফিরদের হত্যা করে গনিমত নিয়ে ফিরে আসে। তাদের ধারণা ছিল, সেদিন জমাদিউস সানির শেষ তারিখ; কিন্তু আসলে তা ছিল রজবের পহেলা তারিখ, যা নিষিদ্ধ মাসের অন্তর্ভুক্ত। এতে কাফিররা এই বলে নিন্দা জানায় যে মুহাম্মদ (সা.) তো নিষিদ্ধ মাসকেও বৈধ করেছেন এবং নিজ সেনাদের নিষিদ্ধ মাসে লুটতরাজের অনুমিত দিয়েছেন। তখন মুসলমানরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে আরজ করে, আমাদের দ্বারা ভুলে এ কাজ হয়ে গেছে। এখন করণীয় কী? তখনই এই আয়াত নাজিল হয়, ‘তারা আপনার কাছে সম্মানিত মাস প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে যে তাতে যুদ্ধ করা কেমন? আপনি বলে দিন যে এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৭)। হারাম তথা সম্মানিত মাস হলো চারটি—জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। জাহেলি যুগ থেকে এ চারটি মাস সম্মানিত হিসেবে চলে আসছে। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ করা হারাম। বেশির ভাগ ইসলামী আইনবিদ ও ইমাম জাসসাসের মতে, এ নিষেধাজ্ঞা বর্তমানে রহিত হয়ে গেছে। আতা ইবনে আলী রাবাহ শপথ করে বলেছেন যে এ আদেশ সর্বযুগের জন্য। তাবেয়িদের অনেকেও এ আদেশকে স্থায়ী আদেশ বলে উল্লেখ করেছেন। সারকথা হলো, আক্রান্ত হলে সম্মানিত মাসেও যুদ্ধবিগ্রহ করা জায়েজ।</p> <p> </p> <p>৫. মদ ও জুয়ার বিধান প্রসঙ্গে : সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবী (সা.)-কে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তাদের বলে দিন, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ, আবার মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে। তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৯)</p> <p> </p> <p>৬. কী পরিমাণ ব্যয় করবে : সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন যে কী পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাহে ব্যয় করতে হবে? তখনই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘আর তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে যে কী পরিমাণ সম্পদ তারা (আল্লাহর রাহে) ব্যয় করবে? আপনি তাদের বলে দিন, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচবে তা খরচ করবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৯)</p> <p> </p> <p>৭. এতিম ও অনাথদের বিধান প্রসঙ্গে : কিছু লোক এতিমের অর্থ-সম্পত্তিতে সাবধানতা অবলম্বন করত না। অতঃপর তাদের আদেশ করা হয়, সদুদ্দেশ্য ছাড়া এতিমের সম্পত্তির নিকটবর্তীও হবে না। এর ফলে যারা এতিমের লালন-পালন করত, তারা ভয় পেয়ে যায়। তারা এতিমের খাওয়াদাওয়াসহ যাবতীয় খরচ পৃথক করে ফেলে। কেননা একত্রে থাকলে অনেক সময় এতিমের বস্তুও খাওয়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এর ফলে নতুন এক সমস্যা দেখা দিল। এতিমের জন্য কোনো কিছু তৈরি করার পর যা বেঁচে থাকত, তা নষ্ট হয়ে যেত, যা ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকত না। এই সতর্কতার ফলে উল্টো এতিমের ক্ষতি হতে লাগল। বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উত্থাপিত হলে তখনই এ আয়াত নাজিল হয়, ‘আর তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে এতিমদের বিধান প্রসঙ্গে। আপনি তাদের বলে দিন, তাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে গুছিয়ে দেওয়া উত্তম, আর যদি তাদের ব্যয়ভার নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নাও, তাহলে মনে করবে তারা তোমাদের ভাই।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২০)</p> <p> </p> <p>৮. ঋতুস্রাব প্রসঙ্গে : ইহুদি ও অগ্নিপূজকরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীলোকের সঙ্গে পানাহার ও এক ঘরে বসবাসকেও অবৈধ মনে করত। অপরদিকে খ্রিস্টান সম্প্রদায় সহবাসও পরিহার করত না। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে এই আয়াত নাজিল হয়, ‘আর তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে হায়েজ বা ঋতুস্রাব প্রসঙ্গে। আপনি তাদের বলে দিন, এটি কষ্টকর অবস্থা। সুতরাং তোমরা হায়েজ অবস্থায় স্ত্রী থেকে বিরত থাকো। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়। যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে তখন তাদের কাছে গমন করবে। যেভাবে আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)</p> <p> </p> <p>৯. হালাল বস্তু প্রসঙ্গে : তাদের জন্য কী কী জিনিস হালাল, তা তাদের জানা ছিল না। ফলে তারা প্রিয় নবী (সা.)-কে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেন। আল্লাহ তাআলা প্রত্যুত্তরে ইরশাদ করেন, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে কী কী জিনিস তাদের জন্য হালাল? আপনি তাদের বলে দিন, তোমাদের জন্য পবিত্র জিনিসগুলো হালাল করা হয়েছে। যেসব শিকারি জন্তুকে তোমরা প্রশিক্ষণ দাও শিকারের প্রতি প্রেরণের জন্য এবং এদের ওই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দাও, যা আল্লাহ তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। এমন শিকারি জন্তু যে শিকারকে তোমাদের জন্য ধরে রাখে, তা খাও এবং তার ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। নিশ্চয় আল্লাহ সত্বর হিসাব গ্রহণকারী। আজ তোমাদের জন্য পবিত্র জন্তুগুলো হালাল করা হয়েছে। আহলে কিতাবদের খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য তাদের জন্য হালাল।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৪-৫)</p> <p> </p> <p>১০. গনিমতের মাল প্রসঙ্গে : গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ মাল কিভাবে বণ্টিত হবে তার বিধান সাহাবায়ে কেরামের জানা ছিল না। তাই তারা মহানবী (সা.)-কে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে আল্লাহ তাআলা প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘তারা আপনার কাছে গনিমতের মালের বিধান প্রসঙ্গে জানতে চায়। আপনি তাদের বলে দিন, গনিমতের মাল হলো আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের। অর্থাৎ গনিমতের মাল আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক রাসুলুল্লাহ (সা.) বণ্টন করবেন।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ১১)</p> <p> </p> <p>১১. রুহ প্রসঙ্গে : ইহুদিরা পরীক্ষা করার জন্য মহানবী (সা.)-কে রুহ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যুত্তরে ইরশাদ করেন, ‘তারা আপনাকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদের বলে দিন, রুহ আমার পালনকর্তার আদেশ। এ বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮৫)</p> <p> </p> <p>১২. জুলকারনাইন প্রসঙ্গে : মহানবী (সা.)-এর নবুয়তের সত্যতা যাচাই করার জন্য ইহুদিরা জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘তারা আপনাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদের বলুন, আমি তোমাদের কাছে তার কিছু অবস্থা বর্ণনা করব।’ (সুরা : কাহাফ, আয়াত : ৮৩)</p> <p>জুলকারনাইন একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। জুলকারনাইন অর্থ দুই শিংবিশিষ্ট। তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দেশগুলো জয় করার কারণে জুলকারনাইন উপাধিতে ভূষিত হন। কারো মতে, তাঁর মাথায় শিংয়ের মতো দুটি চিহ্ন ছিল। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, তাঁর মাথার দুই দিকে দুটি ক্ষতচিহ্ন ছিল। কোরআন মজিদের বর্ণনা অনুযায়ী সূর্য উদয়ের এলাকায় ইয়াজুজ-মাজুজের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।</p> <p> </p> <p>১৩. পাহাড় প্রসঙ্গে : সাহাবায়ে কেরাম মহানবী (সা.)-এর কাছে বিশাল সৃষ্টি পাহাড় সম্পর্কে জানতে চান। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যুত্তরে ইরশাদ করেন, ‘তারা আপনাকে পাহাড় সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আপনি তাদের বলুন, আমার পালনকর্তা কিয়ামতের সময় পাহাড়গুলোকে সমূলে উত্পাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দেবেন।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১০৫)</p> <p> </p> <p>১৪. কিয়ামত প্রসঙ্গে : মক্কার লোকেরা মহানবী (সা.)-এর কাছে কিয়ামত প্রসঙ্গে জানতে চায় যে কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? আল্লাহ তাআলা প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ামত কখন হবে? এর বর্ণনার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? এর চরম জ্ঞান আপনার পালনকর্তার কাছে।’ (সুরা : নাজিয়াত : ৪২-৪৪)</p> <p>ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, গায়েবের কুঞ্জি পাঁচটি, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ১. মাতৃগর্ভে কী সন্তান গুপ্ত রয়েছে (নেককার, না বদকার), ২. আগামী দিন কী সংঘটিত হবে, ৩. বৃষ্টি কখন হবে, ৪. সে কোন ভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং ৫. কিয়ামত কখন হবে? (বুখারি, হাদিস : ৩৬৪১)</p> <p>লেখক : প্রধান ফকিহ</p> <p>আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী</p> <p> </p>