<p>‘জালিম সেদিন নিজের দুই হাত দংশন করতে করতে বলবে, হায় দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ২৮)</p> <p>ইসলামে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। পার্থিব এই জীবনে মূলত সে-ই বেশি সুখী, যার ভালো বন্ধুর সংখ্যা বেশি। বন্ধুত্ব আমাদের একাকিত্বকে যেমন ভুলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি জীবনটাকেও আনন্দে পরিপূর্ণ করে। যেকোনো মানুষকে চেনা যায় তার বন্ধু কেমন তার মাধ্যমেই, বিপদে যে এগিয়ে আসে, দেখা হলে মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ভুলত্রুটি যে সংশোধন করে, সে-ই তো প্রকৃত বন্ধু। তাই আমাদের জীবনে যেমন চরিত্রবান বন্ধু প্রয়োজন, ঠিক তেমনি আমাদের ছেলে-মেয়েদের বিকাশের জন্যও প্রয়োজন সৎ ও চরিত্রবান বন্ধু নির্বাচন। বন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের সব সময় প্রভাবিত করে। আমাদের যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে এবং যাদের বর্জন করতে হবে, সে ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক এবং রাসুল (সা.) আমাদের পথ দেখিয়েছেন। এমনকি নিজের বাবা ও ভাই যদি অবিশ্বাসী হয়, তাহলে তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব না রাখার আদেশ এসেছে। এই মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজ পিতা ও ভাইদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালোবাসে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ২৩)</p> <p>কোরআনের অন্যত্র এসেছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুসলমানদের বাদ দিয়ে কাফিরদের বন্ধু বানিয়ো না। তোমরা কি এমনটা করে নিজের ওপর আল্লাহর প্রকাশ্য দলিল কায়েম করে দেবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৪) আবার অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গ্রহণে ইসলাম সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে, মূলত তারা একে অপরের বন্ধু। এই মর্মে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ জালিমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫১) একজন ঈমানদার যদি ঈমানদার ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তাহলে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই মর্মে ইরশাদ হচ্ছে, ‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২৮)</p> <p>আমরা যদি মহান আল্লাহকে আমাদের জীবনে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে কোনো ভয় বা চিন্তা আমাদের জীবনে আসবে না। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনো ভয়ভীতি নেই, তাদের কোনো চিন্তাও নেই।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৬২)</p> <p>আর বন্ধুত্ব তার সঙ্গেই করতে হবে, যার আছে আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস। এ ব্যাপারে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথা শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তাআলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৭১)</p> <p>বন্ধুত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনীষীদেরও দিকনির্দেশনা রয়েছে, ইমাম গাজ্জালি (রহ.) কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হলে তিনটি গুণের দিকে লক্ষ রাখার কথা বলেছেন—১. নেককার ও পুণ্যবান, ২. চরিত্রবান, ৩. জ্ঞানী ও বিচক্ষণ।</p> <p>হজরত ইমাম জয়নুল আবেদিন তাঁর ছেলে ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকিকে উপদেশ দিতে গিয়ে পাঁচ ধরনের মানুষের সঙ্গে বন্ধু নির্বাচন করতে নিষেধ করেছেন—</p> <p>১. মিথ্যাবাদী, ২. পাপী, ৩. কৃপণ, ৪. বোকা ও আর ৫. যারা স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা করে।</p> <p>আমাদের প্রত্যেকেরই বন্ধুত্ব করতে হবে পরকালের কল্যাণে মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তেই। তাই পরকালের কল্যাণের জন্য এই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বন্ধু নির্বাচন করতে হবে পরিপূর্ণ ঈমানদার দেখে। এ ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশ এসেছে, ‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং মুমিনগণ—যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং বিনম্র।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫৫)</p> <p>আপনি যার সঙ্গে চলছেন সেই বন্ধুটি ভালো না খারাপ তা নির্ণয় করার কষ্টিপাথর আপনার কাছেই আছে। আসলে কারো সঙ্গে চলার পর যদি ভালো গুণ আপনার ভেতরে আসতে থাকে, তাহলে মনে করতে হবে সে আপনার ভালো বন্ধু। অন্যদিকে যদি খারাপ কিছু আসতে থাকে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব সেই বন্ধু ত্যাগ করে একাকী জীবন কাটানো এবং ভালো বন্ধু খুঁজে বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ।</p> <p>তাই বন্ধু নির্বাচনে আমাদের বেশ সতর্ক হতে হবে। আমাদের বন্ধুত্ব করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এ জগতে যারা চরিত্রবান, দয়াবান, দেখা হলেই যারা আমাদের মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা সব সময় আমাদের দোষ না খুঁজে বরং সংশোধন করে দেয়, তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট থাকুক সারাটা জীবন। আমরা আমাদের জীবনে রাসুলে পাক (সা.)-এর হাদিসটি অনুসরণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করে ঈমান পরিপূর্ণ করতে পারি— ‘যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাউকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঘৃণা করে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে দান করে কিংবা না করে, সে তার ঈমান পূর্ণ করে নিল।’ (আবু দাউদ)</p> <p>লেখক : ব্যাংকার</p>