<p>সাবাহ পূর্ব মালয়েশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ। বোর্নিও দীপপুঞ্জের উত্তরে অবস্থিত মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ। সমুদ্রপথে ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সীমান্ত রয়েছে। রাজধানী কুটা কিনাবালো। মূল শহর কুদাত, সানদাকান, ওয়েস্ট কোস্ট ও তাওয়াউ। ৭৩ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই প্রদেশ ৩৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস করে। ৩০ হাজার বছর আগে এখানে মানবজাতির বসবাস। সাবাহ কখনো ব্রুনেই, কখনো জাপান, কখনো ব্রিটেনের অধীনে শাসিত হয়। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সাবাহকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ওই বছর সাবাহ মালয়েশিয়া ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত হয়। ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার চালু রয়েছে এখানে। একজন সাংবিধানিক সুলতান বা রাজা থাকলেও নির্বাহী ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন চিফ মিনিস্টার। তিনিই সরকারপ্রধান।</p> <p>সাবাহ প্রদেশে পাঁচটি বিভাগের অধীনে ২৭টি প্রশাসনিক জেলা রয়েছে। মালয় সরকারি ভাষা এবং ইসলাম রাষ্ট্রীয় ধর্ম। অন্য ধর্মাবলম্বীরা নির্বিঘ্নে তাঁদের ধর্ম ও কৃষ্টির অনুশীলন করার স্বাধীনতা ভোগ করে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সাবাহর অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। পেট্রল, গ্যাস, টিম্বার, পাম তেল ও কৃষিজাত পণ্য রাষ্ট্রীয় আয়ের   প্রধান উৎস।</p> <p> </p> <p><strong>ইসলামের আগমন</strong></p> <p>দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে ব্রুনেই ও সুলু সালতানাতের প্রভাবে এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। আরব ও ভারতীয় সুফি সাধক ও বণিকরা এ অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বপ্রথম বাজাও জনগোষ্ঠী ইসলাম কবুল করে। ধীরে ধীরে বিসায়া, ব্রুনেই, সুলুক, ককোস, ইরানুন, বুগিস ও ওরাং সুংগাই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ মুসলমান সুন্নি ও শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী। সাইয়্যেদ বংশীয় দরবেশ সাধকদের মাধ্যমে এখানে ইসলাম বিকশিত হয়। ৬৫ শতাংশ মুসলমান, ২৬.৬ শতাংশ খ্রিস্টান, ৬ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৪২ জাতের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী আছে সাবাহয়। তাদের রয়েছে নিজস্ব আচার, সংস্কৃতি, ভাষা ও বিশ্বাস।</p> <p>উচ্চতর জিডিপির দিক দিয়ে মালয়েশিয়ার ১০টি প্রদেশের মধ্যে সাবাহর স্থান ষষ্ঠ (৮০,১৬৭ মিলিয়ন রিংগিত)। রাষ্ট্রীয় মসজিদ, প্রাচীন ন্যাশনাল পার্ক, নানা প্রজাতির বৃক্ষ, বিচিত্র সৌন্দর্যে সমন্বিত বন্য প্রাণী, গরম পানির ঝরনাধারা, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, বনাচ্ছাদিত দ্বীপ, সমুদ্রসৈকত, পার্বত্য গুহা, জাদুঘর, নৌবিহার, বেলুনে আকাশভ্রমণ, ডুবুরিদের সঙ্গে মুখে শ্বাসযন্ত্র লাগিয়ে সমুদ্রতল পরিদর্শন (Scuba diving), নৌবিহার, প্রমোদভ্রমণ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্ণাঢ্য জীবনরীতি সাবাহ প্রদেশের মূল আকর্ষণ। ন্যাশনাল পার্ক কিনাবালো থেকে ৮৮ কিলোমিটার দূরে। ৭৫৪ বর্গকিলোমিটারজুড়ে এই পার্কের অবস্থান। হাজার প্রজাতির বৃক্ষ, বিচিত্র পাখপাখালি ও বর্ণিল অর্কিড ফুলের সমারোহ পর্যটকদের কাছে টানে। এটাকে ইউনেসকো কর্তৃপক্ষ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে।</p> <p> </p> <p><strong>১২ হাজার মানুষের একসঙ্গে নামাজ আদায় </strong></p> <p>মালয়েশিয়ার অঙ্গরাজ্য সাবাহর রাজধানী কুটা কিনাবালোতে অবস্থিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ হলো সাবাহ সিটি মসজিদ। স্থানীয়দের কাছে এটি মসজিদে বান্দারায়া নামে পরিচিত। আমরা এই মসজিদ পরিদর্শন করি এবং জামাতের সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। তরুণ মালয় ইমামের তিলাওয়াত বেশ আকর্ষণীয়। নামাজ শেষে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন বলে জানালেন।</p> <p>১৯৯২ সালে এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০০০ সালে। তিন কোটি ৪০ লাখ রিংগিত ব্যয়ে নির্মিত এই মসজিদে মদিনার মসজিদে নববীর স্থাপত্যকাঠামো অনুসরণ করা হয়। নীল ও সোনালি বর্ণের গম্বুজে রয়েছে আরব স্থাপত্যের প্রভাব।</p> <p>দক্ষিণ চীন সাগরের অন্তর্গত লিকাস উপসাগরের তীরে ১৪.৮৩ একর জমি জুড়ে অবস্থিত এই মসজিদ কমপ্লেক্স। চারদিক খোলামেলা। অজু ও টয়লেটের সুব্যবস্থা। বিশাল পার্কিং প্লেস। দূরের মুসল্লিদের সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। জামাতের সঙ্গে ১২ হাজার মুসল্লির নামাজ আদায়ের সুযোগ রয়েছে।</p> <p>মসজিদের তিন দিকে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ। ফলে দূর থেকে মসজিদটি ভাসমান মনে হয়। কমপ্লেক্সের আওতায় রয়েছে এটিএম বুথ, তিনটি মাদরাসা, একটি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক ও মৎস্যখামার। দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে সব সময়।</p> <p> </p> <p><strong>মালয়েশিয়ার সাবাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি </strong></p> <p>সাবাহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সাগরতীরে অবস্থিত ক্যাম্পাসের দৃশ্য মনোরম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, অনুষদ ভবন, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় মসজিদ, অডিটরিয়াম, খেলার মাঠ ও চ্যান্সেলরের কার্যালয় ঘুরে ঘুরে দেখি।</p> <p>তৃতীয় তলার সেন্ট্রাল লাইব্রেরি একাডেমিক ও রেফারেন্স গ্রন্থের বিপুল কালেকশনে ভরা। নোবেল বিজয়ীদের তথ্য-উপাত্ত ও জীবনপঞ্জি নিয়ে সাজানো হয়েছে একটি কক্ষ। ই-লাইব্রেরি, মাল্টিমিডিয়া ল্যাব, স্ক্রিনিং কক্ষ, নামাজের কক্ষ, প্রশিক্ষণ কক্ষ, লকার, প্রিন্টিং ও ফটোকপি সার্ভিস, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাঠকক্ষ ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটদের গবেষণার জন্য রয়েছে ছোট ছোট কক্ষ। একান্ত নিরিবিলি পরিবেশে এখানে গবেষণা করার সুযোগ অবারিত। সেন্ট্রাল এসি থাকায় লেখাপড়ায় ক্লান্তি অনুভূত হয় না। কোনো বই বাসায় নিতে চাইলে তারও ব্যবস্থা আছে। কম্পিউটারে তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। অননুমোদিত গ্রন্থ নিয়ে বের হতে চাইলে ইলেকট্রনিক গেটে রিং বেজে উঠবে।</p> <p>শিক্ষকরা ৯০ দিনের জন্য ৩০টি, ম্যানেজমেন্ট স্টাফ ২৫টি, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট গবেষকরা ২০টি গ্রন্থ ৩০ দিনের জন্য নিতে পারেন। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা যথাক্রমে ১০টি ও ৫টি বই ১৪ দিনের জন্য লাইব্রেরি থেকে ধার নিতে পারেন।</p> <p> </p> <p><strong>সাবাহ জাতীয় মসজিদ</strong></p> <p>কুটা কিনাবালোর সেমবুলানে অবস্থিত সাবাহ স্টেট মসজিদ পরিদর্শন করি এবং জোহরের নামাজ আদায় করি। এটি স্থানীয়দের কাছে মসজিদে নিগারা নামে সমধিক পরিচিত। বিশাল এলাকাজুড়ে মসজিদের অবস্থান। মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। ১৯৭৫ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলেও উদ্বোধন হয় ১৯৭৭ সালে। সময় লাগে পাঁচ বছর। পাঁচ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। মহিলাদের নামাজ আদায়ের জন্য রয়েছে পর্দাঘেরা পৃথক স্থান। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে দামি কার্পেট, ঝুলন্ত বাতি, অলংকরণ ও পবিত্র কোরআনের ক্যালিগ্রাফি।</p> <p>মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান ইয়াহইয়া পেত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদটি উদ্বোধন করেন। মসজিদে সোনালি বর্ণের গম্বুজ ১৭টি এবং মিনার আছে একটি, যার উচ্চতা ২১৫ ফুট। স্থাপত্যশৈলীতে ইসলামী, আধুনিক ও মধ্যপ্রাচ্যরীতি অনুসৃত হয়। ইংরেজি ও মালয় ভাষা জানা একজন গাইড রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি মসজিদের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখান।</p> <p>সাবাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় মসজিদ। ভেতরের সুদৃশ্য অলংকরণ আরো মনোরম। প্রতিদিন শত শত চীনা পর্যটক মসজিদ পরিদর্শনে আসে। আমরা আছরের নামাজ এই মসজিদে আদায় করি।</p> <p><strong>লেখক :</strong> সাবেক অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম</p> <p>খতিব, হজরত ওসমান (রা.) জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম</p>