<p>ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। দিল্লির সুলতানাতের পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে তুঘলকদের আমলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় সবচেয়ে বেশি। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ২৫ বছরের শাসনামলে শুধু দিল্লিতেই প্রায় এক হাজার মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিরোজশাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি.) তাঁর রাজত্বকালে শিক্ষা খাতে মোট ১,৩০,০০,০০০ তংকা ব্যয় করেছেন। এ থেকে আলেম ও শিক্ষকরা পেয়েছেন ৩৬,০০,০০০ তংকা। অবশিষ্ট অর্থ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গ্রন্থ সংগ্রহ, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি কাজে ব্যয় করা হয়। এভাবেই আলেম-উলামা সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতেন।</p> <p>বাংলার সুলতানরা শুধু শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন তা-ই নয়, সেই সঙ্গে শিক্ষক ও বিদ্বান ব্যক্তিদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানীরও ব্যবস্থা করেছিলেন। সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ খিলজি আলেম ও মাশায়েখদের (ধর্ম ও আইনবিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানী) অবসর ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সময়ে লখনউতে আগত জালালউদ্দিন নামক একজন প্রখ্যাত সুফিকে দরবারে ডেকেছিলেন বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে তাঁকে সুলতান দরবার থেকে প্রায় আট হাজার রৌপ্যমুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন।</p> <p>সুলতানি যুগেই আরবি-ফারসি জানা শিক্ষিত ব্যক্তিদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন ইসলাম ধর্মীয় পণ্ডিত, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁদের বিভিন্ন শিলালিপিতে।</p> <p>মাদরাসাশিক্ষিত আলেম-উলামার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোগল শাসকদেরও। এমনকি কোনো কোনো সম্রাট আলেমদের যুদ্ধক্ষেত্রেও নিয়ে যেতেন প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য।</p> <p>মোগল আমলে আলেমরা প্রধানত তিনটি বিশেষ কাজে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতেন—এক. রাজপরিবারের শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া, দুই. আদালতে কাজিগিরি বা বিচারকের দায়িত্ব পালন এবং তিন. সম্রাটদের বিভিন্ন রকমের দাতব্য কাজকর্মের তদারকি করা।</p> <p>এ বিষয়ে ইংরেজ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন : ‘কাজি অথবা মুসলমান আইনজ্ঞরা দেওয়ানি আদালতে বিচার করতেন। এমনকি আমরা যখন সর্বপ্রথম শিক্ষিত আহলে বিলাতি দিয়ে এ দেশের বিচারকাজ চালানোর চেষ্টা করেছি, তখনো মুসলমান আইনজ্ঞরা আইনের পরামর্শদাতা হিসেবে তাদের সঙ্গে রীতিমতো উঠাবসা করতেন। ইসলামী বিধিব্যবস্থাই এ দেশের আইন-কানুন ছিল এবং সরকারি ছোটখাটো অফিসগুলো মুসলমানদেরই সম্পত্তি ছিল। তারাই সরকারি ভাষা বলতে পারত এবং প্রচলিত ফারসি অক্ষরে লেখা সরকারি নথিপত্র একমাত্র তারাই পড়তে পারত।’ (উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, আবদুল মওদুদ অনূদিত, আহমদ পাবলিশিং হাউস, বাংলাবাজার, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ, জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ১০৯)</p> <p>উপমহাদেশে মুসলিম যুগের অবসান ঘটে বেনিয়া ইংরেজদের আমলে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়াদের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা এসেই তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী শিক্ষামাধ্যম মাদরাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করার ফন্দি বের করে। গবেষক এ জেড এম শামসুল আলম লিখেছেন : ‘বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পর থেকে প্রায় ৫০০ বছর পর্যন্ত সুবা-বাংলা ছিল জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র। মুসলিম সুবাদার, সুলতান, নায়েব, নাজিমরা মাদরাসা-খানকার জন্য উদারহস্তে দান করতেন। নগদ অর্থ যা দিতেন, লাখেরাজ সম্পত্তি দিতেন তার চেয়ে অনেক বেশি।’ (এ জেড এম শামসুল আলম, মাদরাসা শিক্ষা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, মে ২০০২, পৃষ্ঠা ৩-৪) ১৮৩৭ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে সরকারি কাজকর্মে, অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষা চালু করা হয়। ইংরেজরা কূটবুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে চুপে চুপে ইংরেজিকরণের নীতি চালু করে। আর এর মধ্য দিয়ে আরবি-ফারসি জানা এবং দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ ৫০০ থেকে ৭০০ আলেম রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ হয়ে যায়। বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের ‘অশিক্ষিত’ ঘোষণা দেওয়া হয়।</p> <p>উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ অপশাসন দূরীভূত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশদের কূটচালের ফলে উপমহাদেশের মুসলমান ও আলেমসমাজের যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়েছে, গত কয়েক শ বছরেও তা থেকে আলেম-উলামা বের হতে পারেননি বা বের হতে দেওয়া হয়নি।</p>