<p>ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ইসলামের যেসব নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তার বেশির ভাগই উসমানীয় শাসকদের হাতে গড়ে উঠেছিল। তবে ইউরোপের মাটিতে তুর্কি অভিযানের একমাত্র কারণ সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল না; বরং গণমানুষের মুক্তি, মুসলিম উম্মাহর স্বার্থরক্ষা, আন্তর্জাতিক নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি কারণ ছিল তাদের অভিযানের পেছনে। সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাইপ্রাসে তুর্কি অভিযানের পেছনেও ছিল এমন কিছু কারণ। অখণ্ড (তুর্কি ও গ্রিক) সাইপ্রাস প্রায় তিন শ বছর শাসন করেন তুর্কি সুলতানরা।</p> <p>তুরস্কে উসমানীয় শাসন প্রতিষ্ঠার সময় প্রতিবেশী সাইপ্রাস শাসন করত রিপাবলিক অব ভেনিস। সব দিক বিবেচনায় তা ছিল একটি নির্মম ঔপনিবেশিক শাসন। সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও জনগণের দুঃখের শেষ ছিল না। কিন্তু সব কিছু চলে যেত ভেনিসে। ভেনিসের রাজা সাইপ্রাসে দুজন শাসক নিয়োগ দিয়েছিলেন। তারাই সাইপ্রাস, সমুদ্রপথ ও বন্দরগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। প্রতিনিয়ত উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটলেও তুর্কি ভূখণ্ড থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাইপ্রাসের প্রতি মনোযোগ ছিল না তুর্কি শাসকদের। প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ এই দ্বীপটি দখলেরও চিন্তা ছিল না তাদের। কিন্তু সাইপ্রাসের শাসকদের অবিচার, নৌপথে দস্যুতা, সুযোগ পেলেই মুসলিম জাহাজ লুণ্ঠন এবং হজযাত্রীদের ওপর আক্রমণের খবর তুর্কি শাসকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে।</p> <p>তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের শাসনামলে সাইপ্রাসের অন্যায় ও অবিচার সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলে তিনি সাইপ্রাস নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেন। সুলতান সেলিমের এই অভিযানের পেছনে দুটি প্রধান কারণ হলো—হজযাত্রীদের জাহাজ লুট ও ৫০ জন হজযাত্রীকে বন্দি করে রাখা এবং ভেনিসের সংখ্যালঘু ইহুদি ও গ্রিকদের অনুরোধ। সুলতান সেলিমের ইহুদি সভাসদ জোসেফ নাজি সুলতানকে এই অভিযানে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি চাইতেন, সুলতান সাইপ্রাসের ইহুদিদের মুক্ত ও স্বাধীন জীবন উপহার দিন। এ ছাড়া বাণিজ্যিক জাহাজ লুট, মুসলিমদের ওপর আক্রমণ ও হজযাত্রায় বাধা প্রদানের সংবাদ শুনে শুনে চরম বিরক্ত ছিলেন তিনি। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সাইপ্রাসে দূত প্রেরণ করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। কিন্তু ভেনিস ও সাইপ্রাসে নিযুক্ত তাদের শাসক সুলতানের বার্তা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ সাইপ্রাসের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও অফুরন্ত খাদ্যভাণ্ডার তাদের অহংকারী করে তুলেছিল।</p> <p>নিকোসিয়া শহরকে সাইপ্রাসের রাজধানী নির্ধারণ করে নিকোলাস ডান্ডোলোকে এবং বন্দরনগরী ফার্মাগুস্তায় মার্ক এন্তোনিও ব্রাগাদিনকে শাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারা ভেনিসকে সাইপ্রাস রক্ষার অভয় দেয়। একই সঙ্গে ইউরোপের খ্রিস্টান শাসকদের ‘দ্য হলি লিগ’ ছিল তাদের ভরসার আরেকটি জায়গা। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম সাইপ্রাস অভিযানের সব আয়োজন সম্পন্ন করেন। লালা মোস্তফা পাশাকে তিনি এই অভিযানের দায়িত্ব দেন। অন্যদিকে মুসলিম অভিযানের সংবাদে ইহুদি, গ্রিক ও খ্রিস্টানদের একাংশ তুর্কিদের পক্ষে সংগঠিত হয়।</p> <p>১৫৭০-এর সেপ্টেম্বরে লালা মোস্তফা পাশা নিকোসিয়ায় আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠান। কিন্তু উত্তরে তারা আবারও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। ফলে তুর্কি বাহিনীর সামনে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকল না। সুলতানের বাহিনী সাইপ্রাসের মাটিতে গোলাবারুদ নিক্ষেপ শুরু করে। দুর্গের ভেতর থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত নিকোসিয়ার পতন হয়। ৯ সেপ্টেম্বর একপ্রকার বিনা বাধায় ক্যারেন শহর জয় করে মুসলিম বাহিনী।</p> <p>১৫ সেপ্টেম্বর বন্দরনগরী ফার্মাগুস্তায় পৌঁছে যায় লালা মোস্তফার বাহিনী। তারা ব্রাগাদিনকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করলে লালা মোস্তফা দুর্গ অবরোধ করেন। পাঁচটি গেট, ১৫টি বুরুজ এবং দুর্গের চারপাশের গভীর পরিখা—সব মিলিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা বেশ মজবুত ছিল। তারপর মুসলিম অভিযান শুরু হওয়ার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়।</p> <p>লালা মোস্তফা চাইছিলেন অবরোধের অবকাশে আহত সৈন্যরা বিশ্রাম পাক এবং নতুন সৈন্য আসুক। আর ব্রাগাদিন অপেক্ষা করছিল ‘দ্য হলি লিগ’-এর সম্মিলিত বাহিনীর জাহাজের। কিন্তু তুর্কি বাহিনীর জয়যাত্রা ও বিক্রমের কারণে বেশির ভাগ ইউরোপীয় শাসক যুদ্ধে যোগদানে সম্মত হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি জাহাজ ও ১৭০০ সৈন্যের বহর নিয়ে ক্রিট থেকে যাত্রা করেন জেনারেল মার্ক কুরিনি। কিন্তু তিনি সম্মুখ আক্রমণে না গিয়ে তিনটি জাহাজ দিয়ে তুর্কিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আর অন্য জাহাজগুলো বিক্ষিপ্তভাবে তুর্কি জাহাজগুলোর ওপর আকস্মিক আক্রমণ শুরু করে। তিন সপ্তাহ পর তারা ফিরে যায়।</p> <p>দীর্ঘ অপেক্ষার পর এপ্রিলে নতুন তুর্কি সৈন্যরা সাইপ্রাসে এলে লালা মোস্তফা সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন। তবে চূড়ান্ত হামলার পূর্বে ব্রাগাদিনকে আবারও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ব্রাগাদিন তা প্রত্যাখ্যান করে। জুনের শেষ সপ্তাহে দুর্গের দেয়ালের একাংশ ধসে পড়ে। আবার দুর্গে তীব্র খাদ্যসংকট তৈরি হয়। ফলে জনসাধারণের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের চাপ আসতে থাকে। ১৫৭১ সালের ১ আগস্ট ব্রাগাদিন আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। ৫ আগস্ট সে শহর ও দুর্গের চাবি লালা মোস্তফার হাতে তুলে দেয়। এ সময় প্রকাশ পায়, ব্রাগাদিন বন্দি হজযাত্রীদের হত্যা করেছে। তখন জিম্মি হত্যার দায়ে ব্রাগাদিন শাস্তির মুখোমুখি হয়। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত সাইপ্রাসে তুর্কি শাসন অব্যাহত ছিল। রুশ-তুর্কি যুদ্ধের পর দ্বীপটি ব্রিটেনের দখলে চলে যায়। ১৯৫৯ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সাইপ্রাস।</p>