<p>১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ বায়তুল মোকাররম সোসাইটি ও ইসলামিক একাডেমি ঢাকাকে একীভূত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণার মহান লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ধর্মীয় সেক্টরে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সারা দেশে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু অভিজ্ঞমহল মনে করছে, এক দশক ধরে একজন বিতর্কিত মহাপরিচালকের কারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর অভিযোগ। এসব নিয়ে লিখেছেন <strong>তাজুল ইসলাম</strong></p> <p> </p> <p><strong>যেভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু</strong></p> <p>পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি সর্বপ্রথম ঢাকায় বিপুল ধারণক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে বায়তুল মোকাররম সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই বছরই ঢাকায় কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ মিলে গঠন করেন দারুল উলুম নামের একটি সংগঠন। ১৯৬০ সালে এটিকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয় এবং নাম পাল্টে রাখা হয় ইসলামিক একাডেমি ঢাকা। (সূত্র : ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ’ প্রথম খণ্ড)</p> <p>পরে ১৯৭২ সালে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ইসলামিক একাডেমি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বঙ্গবন্ধু একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ বায়তুল মোকাররম সোসাইটি ও ইসলামিক একাডেমি ঢাকাকে একীভূত করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।</p> <p>দেশের সব শ্রেণির আলেম-উলামা যাতে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ইসলাম প্রচার করতে পারেন, এই উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এরই সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত দিকনির্দেশনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করেন। অ্যাক্টে এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। অ্যাক্টের (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণার আয়োজন করা ও তার প্রসার ঘটানো, জনপ্রিয় ইসলামী সাহিত্য সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলোর সুলভ প্রকাশনা ও বিলিবণ্টনকে উৎসাহিত করা।’</p> <p> </p> <p><strong>মূল কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন?</strong></p> <p>ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মুসলমানদের গৌরবময় প্রতিষ্ঠান। এটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের রয়েছে বহুমুখী কার্যক্রম। এর অন্যতম হলো ইসলামিক মিশন। রয়েছে দ্বিনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগ। আন্তর্জাতিক কিরাত ও হিফজ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগী বাছাই ও প্রেরণ, জাতীয় পর্যায়ে ফিতরা নির্ধারণ, প্রতি মাসে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা আয়োজন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে হয়ে থাকে।</p> <p>ইসলামিক ফাউন্ডেশনের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী একটি প্রকাশনা বিভাগ। রয়েছে ইসলামী বিশ্বকোষ বিভাগ। রয়েছে ইমাম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট। এসব ছাপিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মূল কাজ হলো ইসলাম নিয়ে গবেষণা ও প্রচারণা। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক দশকে ফাউন্ডেশনে মৌলিক কোনো গবেষণা ও প্রকাশনা হয়নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যা কিছু কীর্তি রয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বর্তমান মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল আসার আগে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, সামীম আফজাল একজন উচ্চাভিলাষী ও প্রচারপ্রিয় মানুষ। যেসব কাজ ফলাও করে প্রচার করা যায় এবং প্রকল্পের জন্য মোটা অঙ্কের বরাদ্দ পাওয়া যায়, তিনি সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সদা তৎপর।</p> <p>ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সিরাত [মহানবী (সা.)-এর জীবনী], তাফসির ও ইসলামের মৌলিক বিষয় নিয়ে যেসব অমর কীর্তি রয়েছে, তার বেশির ভাগই এক দশক আগে হয়েছে। কিছু গ্রন্থ বের হলেও সেই অর্থে গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য কীর্তি নেই। আগের সিরাত, তাফসির ও হাদিস বিষয়ক বইগুলোও এখন প্রকাশিত হয় না। পুরনো কোনো বই খোঁজ করলে পাওয়া যায় না—ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্পর্কে পাঠকের এমন অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়।</p> <p>সিরাত, তাফসির ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। সেগুলো অনুবাদ করারও কোনো উদ্যোগ নেই। নতুন কোনো তাফসির অনুবাদ হয় না। অথচ বর্তমানে আরবি ভাষায় বেশ কিছু মূল্যবান তাফসির রচিত হয়েছে; যেমন—ড. ওহাবা জুহাইলির ‘আততাফসিরুল মুনির’ এবং ইবনে আশুরের ‘আততাহরির ওয়াততানভির’ আধুনিক যুগের দুটি শ্রেষ্ঠ তাফসির বলে গোটা বিশ্বে পরিচিত। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এগুলো অনুবাদে কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, মূল ভাষা হিসেবে বাংলায় রচিত দু-একটি তাফসির ছাড়া আর কোনো তাফসিরের গ্রন্থ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোনো উদ্যোগ নেই।</p> <p>ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনূদিত ‘আল-কুরআনুল করীম’-এর প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছে ১৯৬৮ সালে। বাংলাদেশে এই গ্রন্থের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এটি চলিত ভাষায় ভাষান্তর কিংবা আগের সংস্করণগুলোতে থেকে যাওয়া ভুলগুলোও শোধরানো হয়নি।</p> <p>ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলা একাডেমির ভাষারীতির মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য। ধর্মীয় লেখকদের এ নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। এসব বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোনো উদ্যোগ নেই।</p> <p>সিরাত তথা মহানবী (সা.)-এর জীবনী বিষয়ে আধুনিক বিশ্বে চমকপ্রদ বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কিন্তু গত এক দশকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সিরাতচর্চা ‘মিলাদ ও কিয়াম’-এর মধ্যে থেমে আছে।</p> <p>এভাবে বলতে চাইলে বহু বিষয় আনা যায়, যার আলোকে এটা প্রমাণ করা খুবই সহজ যে গত এক দশকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তার মূল লক্ষ্য থেকে বহু দূরে চলে গেছে।</p> <p> </p> <p><strong>সামীম আফজালের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর অভিযোগ</strong></p> <p>২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় সামীম মোহাম্মদ আফজালকে। ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর আরো দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।</p> <p>গত মে মাসের শুরুতে সামীম মোহাম্মদ আফজালকে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আর কেন এই সিদ্ধান্ত, তার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়নি স্পষ্ট করে। বিষয়টি অনেকটাই গোপনে হয়েছে। ২০১৬ সালে তিনি এই নিয়োগ পেয়েছিলেন।</p> <p>সামীম আফজালের আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো পবিত্র জায়গা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। একের পর এক অপকর্ম তিনি সদর্পে করে গেছেন। তাঁর কিছুই হয়নি। তিনি বায়তুল মোকাররমে এমন এক খতিব নিয়োগ দিয়েছেন, যাঁর নামাজের কিরাত (কোরআন তিলাওয়াত) শুদ্ধ কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।</p> <p>ইমাম প্রশিক্ষণের আলেমদের সামনে নারী এনে নাচ দেখানোর দুঃসাহসও তিনি দেখিয়েছেন।</p> <p>সেই ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সামীম আফজালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার।</p> <p>২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হলো—‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন ডিজির দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক’। কিন্তু এই অনুসন্ধানের পরিণতি কী হয়েছে, কেউ জানে না। ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবের একটি খবরের শিরোনাম, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে : মহাপরিচালকের স্বজনপ্রীতির নিয়োগ সভা ভণ্ডুল’।</p> <p>খবরে বলা হয়েছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতির জন্য মঙ্গলবার এই সভার আয়োজন করা হয়। এতে পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য মহাপরিচালকের ফুফাতো ভাই, ভায়রাভাই, পীরভাইসহ ১৫ জনের একটি শর্ট লিস্ট প্রস্তুত করা হয়।</p> <p>সর্বশেষ বায়তুল মোকাররমের পিলার গায়েবকে কেন্দ্র করে সামীম আফজালের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের চিত্র সর্বমহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। একপর্যায়ে তাঁকে শোকজ করেছে মন্ত্রণালয়। উপায় না দেখে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব বিষয় নিয়ে সামীম আফজালের নম্বরে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।</p> <p>আমরা মনে করি, সামীম আফজালের পদত্যাগই একমাত্র সমাধান নয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করা হোক। এবং তাঁর আমলে ‘বিশেষ ক্ষমতা’য় নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে স্বমহিমায় বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া হোক।</p>