<p><strong>মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূতিকাগার বায়তুল হিকমা</strong></p> <p>ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সাড়া জাগানো ও প্রভাবশালী জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র বায়তুল হিকমাহ বা জ্ঞানের ভাণ্ডার। একটি অনুবাদকেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ক্রমেই তা উচ্চতর গবেষণাকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানমন্দিরে পরিণত হয়। আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ বাগদাদে তা প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর মানসুর গ্রিক জ্ঞান ও দর্শনের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তাঁর নির্দেশে চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৌশল ও সাহিত্যের বইগুলো অনুবাদ করা হয়। তিনি রাজপ্রাসাদে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। হারুনুর রশিদ খলিফা হওয়ার পর তা সাধারণ পাঠক, আলেম ও শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। নিজেও বৃদ্ধি করেন সংগ্রহশালা। খলিফা মামুন বায়তুল হিকমাহকে পূর্ণতা দান করেন। তিনি রোম, পারস্য ও ভারতবর্ষ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সাহিত্যের দুর্লভ বই সংগ্রহ করে অনুবাদ ও তার ভিত্তিতে গবেষণার নির্দেশ দেন। খলিফা মামুন নিজেও বায়তুল হিকমার দৈনন্দিন কাজে অংশ নিতেন। তাঁর আমলে বায়তুল হিকমায় জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, চিকিৎসা ও সাহিত্যের ওপর অসংখ্য বই অনূদিত ও রচিত হয়।</p> <p>খলিফা মামুনের যুগকেই বায়তুল হিকমার স্বর্ণযুগ বলা হয়। তবে তার পরও বায়তুল হিকমার কার্যক্রম অব্যাহত। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলীয় শাসক হালাকু খান বাগদাদ দখল করার পর বায়তুল হিকমা ধ্বংস করেন। তার সংগ্রহগুলো দজলা নদীতে নিক্ষেপ করেন। অবশ্য অবরোধের আগেই নাসিরুদ্দিন তুসি চার লাখ বই সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হন। হালাকু খান বায়তুল হিকমার বই নদীতে ফেলেই থামেননি; বরং তাতে অগ্নিসংযোগও করেন। এতে বায়তুল হিকমার মূল্যবান সংগ্রহশালা ধ্বংস হয়ে যায়। কথিত আছে, বায়তুল হিকমা ও অন্যান্য পাঠাগারের বইয়ের কালিতে তখন দজলা-ফোরাতের পানি কালো হয়ে যায়।</p> <p>বায়তুল হিকমার কার্যক্রম কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন : ১. অনুবাদকেন্দ্র। বিভিন্ন ভাষা থেকে বইগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হতো। ইউহান্না বিন মাসাউয়্যা, জিবরিল বিন বাগতিশু ও হুনাইন বিন ইসহাক ছিলেন অনুবাদকেন্দ্রের অন্যতম অনুবাদক। ২. পাঠাগার। সংগৃহীত, অনূদিত ও রচিত বইগুলো সংরক্ষণ করাই ছিল তার মূল কাজ। ৩. মাদরাসা। শিক্ষার্থীদের পাঠদান, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বিতর্কের আয়োজন, গবেষণাকাজ পরিচালনার দায়িত্বে ছিল মাদরাসা। ৪. মানমন্দির। জ্যোতির্বিদ্যার ওপর উচ্চ গবেষণার জন্য এটি নির্মাণ করা হয়।</p> <p>বায়তুল হিকমার অন্যতম অংশ ছিল মানমন্দির ও মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র। এটিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মানমন্দির ও মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র। খলিফা মামুনের নির্দেশে ২১৪ হিজরিতে এই মানমন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। খলিফা মামুন দামেস্কেও অনুরূপ একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। গ্রিক মানমন্দিরের আদলে তা নির্মাণ করা হয় এবং গ্রিক মানমন্দিরে ব্যবহৃত উপকরণ বায়তুল হিকমায় স্থাপন করা হয়। ইয়াহইয়া ইবনে আবি মানসুর, আব্বাস জাওহারি, সিন্দ বিন আলী, আবু সাহাল ফজল, মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি প্রমুখ গবেষককে মানমন্দিরে নিয়োগ দেওয়া হয়।</p> <p>মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় বায়তুল হিকমা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। অবশ্য ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও চিন্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, সাধারণ মানুষের মনে সংশয় তৈরি এবং মুসলিম জাতির মধ্যে আদর্শিক উপদল ও উপদলীয় কোন্দলের পথ তৈরির জন্যও বায়তুল হিকমাকে দায়ী করা হয়। বায়তুল হিকমার কার্যক্রমের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ। তবে তারপর হালাকু খানের হাতে ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ৩২ জন খলিফার সবাই বায়তুল হিকমার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/04 April/26-04-2019/Kalerkantho_19-04-26-09.jpg" style="height:441px; width:665px" /></p> <p><em>মরক্কোতে অবস্থিত পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়</em></p> <p><strong>কারাউইন পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়</strong></p> <p>উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ কোনটি, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় যে মরক্কোর কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে পৃথিবীতে আরো একাধিক উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে শিক্ষার যে কাঠামোকে বোঝানো হয়, তা প্রথম প্রতিষ্ঠা পায় মরক্কোর ফেজ নগরীতে। ফাতিমা নামের একজন মুসলিম নারী বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনন্য গৌরব অর্জন করেন।</p> <p>জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো এই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে এবং মুসলিম প্রতিষ্ঠিত কারাউইনকে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।</p> <p>মরক্কোর ফেজ নগরীতে প্রাচীনতম এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। একজন ধনাঢ্য বিধবা নারী ফাতিমা আল ফিহরি তা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে কারাউইন নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তী সময়ে তার আঙিনায়ই গড়ে তোলা হয় একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে ইতিহাস-ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিষয়ে পাঠদান করা হতো। আরব-আফ্রিকা-ইউরোপের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়ন করত। ১৯১৩-৫৬ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক আমলে ফ্রান্স পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ও সনদ বিতরণ বন্ধ করে দেয় এবং শিক্ষার্থীদের সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৫৬ সালে মরক্কো স্বাধীনতা লাভ করার পর কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন বাদশা মুহাম্মদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত, পদার্থ, রসায়নসহ বিভিন্ন বিজ্ঞান বিভাগ ও আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। ১৯৫৭ সালে খোলা হয় নারীশিক্ষার্থী বিভাগ। ১৯৬৩ সালে কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে মরক্কোর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়।</p> <p>বর্তমানে কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১১০০ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন এবং প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/04 April/26-04-2019/Kalerkantho_19-04-26-10.jpg" /></p> <p><strong>সোনারগাঁয়ে উপমহাদেশের প্রথম হাদিসচর্চা কেন্দ্র</strong></p> <p>উচ্চশিক্ষার জন্য এখনো বিদেশমুখী বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। সেটা যেমন সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সত্য ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও। কিন্তু একটা সময় এমন ছিল, যখন আমাদের দেশেই উচ্চশিক্ষার জন্য আসত দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থীরা। তারা আসত হাদিসশাস্ত্রের উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য। কারণ, বাংলার জমিনেই প্রথম স্থাপিত হয় উপমহাদেশের প্রথম হাদিসচর্চা কেন্দ্র। প্রাচীন এই শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে তুলেছিলেন শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বুখারি আদ-দেহলভি আল হানাফি (রহ.)। আনুমানিক ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং একটি সমৃদ্ধ ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।</p> <p>শায়খ আবু তাওয়ামার জন্মস্থান নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। কারো মতে, তিনি পারস্যের বুখারা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। আর কারো মতে, তাঁর জন্মভূমি ইয়েমেন। হাদিস, ফিকহসহ অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি ভূগোল, গণিত, রসায়ন ও যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের অনুরোধে ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৬৬৮ হিজরিতে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে দিল্লি আগমন করেন। অতঃপর সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর অনুরোধে বাংলায় আসেন।</p> <p>গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর সহযোগিতায় তিনি রাজধানী সোনাগাঁয়ে একটি বৃহৎ মাদরাসা ও সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে আসত। একসময় মাদরাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজারে। শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা দীর্ঘ ২৩ বছর এই সোনারগাঁ মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে ছাত্রদের উদ্দেশে ফিকহ বিষয়ে তিনি যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলোর একটি ফারসি সংকলন এখনো পাওয়া যায়। ‘নামায়ে হক’ নামের এই সংকলনটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই থেকে এবং ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তাঁর লিখিত পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে বলে জানা যায়।</p> <p>শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.) ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে ইন্তেকাল করেন এবং বাংলার মাটিতেই তাঁকে দাফন করা হয়। তবে বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্মৃতিচিহ্নগুলো আজ হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/04 April/26-04-2019/Kalerkantho_19-04-26-11.jpg" /></p> <p><em>দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐতিহাসিক এই বিদ্যাপীঠের স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করে ফেলা হয়</em></p> <p><strong>বাগদাদের বিখ্যাত নিজামিয়া মাদরাসা</strong></p> <p>ইসলামের ইতিহাসে প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠগুলোর অন্যতম বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসা। ইরানের সেলজুক বংশের শাসক উলুপ আরসালানের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী খাজা নিজামুল মুলক তুসি (রহ.) এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। ৪৫৯ হিজরি মোতাবেক ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে নিজামিয়া মাদরাসার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। খাজা নিজামুল মুলক এই মাদরাসা নির্মাণে দুই লাখ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেন। ১০ জিলহজ ৪৫৯ হিজরি সনে নিজামিয়া মাদরাসা আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।</p> <p>বাগদাদ নগরীর দজলা নদীর তীরে রুসাফা নামক স্থানে এই মাদরাসা স্থাপন করা হয়।</p> <p>নিজামিয়া মাদরাসায় সমকালীন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতো। খলিফারা এই মাদরাসাকে নিজেদের জন্য গর্ব মনে করতেন এবং যাবতীয় ব্যয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পরিশোধ করা হতো। ৫০৪ হিজরি মাদরাসায়ে নিজামিয়ার সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়।  নিজামুল মুলক মাদরাসায়ে নিজামিয়াকে একটি পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স হিসেবে গড়ে তোলেন। যেখানে ছাত্রদের আবাসনের সব ব্যবস্থা রাখা হয়। ছাত্রদের জন্য তৈরি করা হয় ছাত্রাবাস, পৃথক পাঠকক্ষ, রান্নাঘর, পানির হাউস ও কূপ, গুদামঘর, পাঠাগার ও মসজিদ।</p> <p>মূল শিক্ষা ভবনটি পবিত্র কাবাঘরের আদলে চতুর্ভুজ আকৃতিতে তৈরি করা হয়। মাঝখানে রাখা হয় বিস্তৃত উঠোন।</p> <p>শত যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও মাদরাসায়ে নিজামিয়া টিকে ছিল শত শত বছর ধরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৪ সালে নিজামিয়া মাদরাসা পরিত্যক্ত হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সড়ক সম্প্রসারণের নামে ঐতিহাসিক এই বিদ্যাপীঠের শেষ স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়।</p> <p>আদর্শিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে মাদরাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। শিয়া মতাদর্শের প্রতিরোধ এবং শাফেয়ি মাজহাবের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠা ছিল নিজামিয়া মাদরাসা স্থাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে নিজামিয়া মাদরাসার প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। নিজামুল মুলক মাদরাসায়ে নিজামিয়ার জন্য একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তোলেন। তাঁর আমলেই পাঠাগারে ১০ হাজারেরও বেশি দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ ছিল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলীয়রা বাগদাদ দখলের পর পাঠাগারটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/04 April/26-04-2019/Kalerkantho_19-04-26-12.jpg" /></p> <p><strong>উপমহাদেশের আলোর মিনার দারুল উলুম দেওবন্দ</strong></p> <p>১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের ওপর যে চতুর্মুখী বিপর্যয় নেমে আসে, তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ। যার উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিকে রক্ষা করা এবং উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করা।</p> <p>সিপাহি বিপ্লবের সময় দিল্লির প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন হজরত কাসেম নানুতবি (রহ.)সহ আলেমদের একটি দল। ভারতের থানাভবনে হজরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন এবং সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। আলেমদের বিপ্লবী ভূমিকার কারণে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করা হয়। তাঁদের বন্দি করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এতে উপমহাদেশের মুসলিমসমাজে একই সঙ্গে শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বসংকট তৈরি হয়। চতুর্মুখী এই সংকটের হাত থেকে মুসলিমসমাজকে রক্ষার জন্য ১৮৬৬ সালের ৩১ মে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করা হয়।</p> <p>দারুল উলুম দেওবন্দ যতটা না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তার চেয়ে বেশি শিক্ষা আন্দোলন। ব্রিটিশদের হাতে মুসলিম শাসকদের পতনের পর উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষায় দারুল উলুম দেওবন্দকেই সবচেয়ে ফলপ্রসূ প্রচেষ্টা বলে ধারণা করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীকালে উপমহাদেশে বৃহত্তর সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা একই সঙ্গে উপমহাদেশের শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে, বিস্তীর্ণ জনপদে অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।</p> <p>উপমহাদেশের বরেণ্য ইসলামী ব্যক্তিত্বদের অনেকেই দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান। মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, মাওলানা আশরাফ আলী থানভি, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা শিব্বির আহমদ ওসমানি, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থী ছিলেন।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/04 April/26-04-2019/Kalerkantho_19-04-26-13.jpg" /></p> <p><strong>মিসরের হাজার বছরের আল-আজহার</strong></p> <p>মিসরের আল-আজহার পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রতিষ্ঠাকালে আল-আজহার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না।</p> <p>৯৭৫ সালে আল-আজহারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। এখানে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি পাঠদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠাকালে আল আজহারের বিভাগ ছিল মাত্র পাঁচটি। সেগুলো হলো—ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, আইন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইসলামিক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা।</p> <p>১৯৬১ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের আল-আজহারকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি আল আজহারের পাঠ্যক্রমে হিসাববিজ্ঞান, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কৃষির মতো আধুনিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেন। নারী শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেন।</p> <p>বর্তমানে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭টি অনুষদ রয়েছে, যার ৪০টি মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং ৪৭টি ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্য। আল আজহারের ১৫ হাজার ১৫৫টি শ্রেণিকক্ষে ৩০ হাজার শিক্ষক পাঠদান করেন এবং পাঠ গ্রহণ করেন পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশই বিদেশি। বর্তমানে ১০২টি দেশের এক লাখ শিক্ষার্থী সেখানে অধ্যয়নরত।</p> <p>নিজস্ব ক্যাম্পাসের বাইরেও আল-আজহার মিসরের প্রায় চার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ লাখ। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের উপাধি প্রেসিডেন্ট। বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম ড. মোহাম্মদ হুসাইন মাহরাসাভি।</p> <p>শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে আল আজহারের রয়েছে সাতটি নিজস্ব হাসপাতাল। কায়রোর সবচেয়ে বড় বাগানের মালিকও আল-আজহার। ৩০ হাজার হেক্টর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বাগানে রয়েছে ৮০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ।</p>