বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া জুলাই বিপ্লবের সমন্বয়কদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ।
এর মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০টি হামলার ঘটনায় সমন্বয়কসহ ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ১২ দিনের মাথায় সুনামগঞ্জে সমন্বয়ক ইমন দোজা আহমেদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়কদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন জুলাই আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক জসিম, শরীফসহ আন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া এ ঘটনায় বশেমুরবিপ্রবি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) আতিক ফয়সাল ও দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেলও আহত হয়েছেন।
গত কিছুদিনে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, পাবনা, রাজশাহী, নওগাঁ, লালমনিরহাট, টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ নিরাপত্তা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোথায় কী কারণে হামলার ঘটনা ঘটছে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
’
সমন্বয়কদের অভিযোগ, পুলিশে এখনো ফ্যাসিবাদের দোসররা থাকায় তাঁরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, নিজেদের স্বার্থেই তাঁদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছিলেন, ভাবেননি বেঁচে থাকবেন। জয়ী হওয়ার পর তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন দুর্নীতিমুক্ত, নিরাপদ ও একটি উন্নত রাষ্ট্রের। এসবের জন্য চাচ্ছেন সংস্কার।
এ পর্যায়ে সমন্বয়কদের ওপর হামলা চালিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে কেউ কেউ।
সূত্র জানায়, গত ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ শহরের প্রিয়াঙ্গন মার্কেট রোডের একটি শপিং মলের সামনে সমন্বয়ক ইমন দোজা আহমদ হামলার শিকার হন। ইমন দোজা জানান, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে দুজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাঁকে কুলঘুষি মেরে পালিয়ে যায়।
গত ১৯ অক্টোবর নওগাঁয় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হন সমন্বয়ক আরমান হোসেনসহ (২২) দুই শিক্ষার্থী। গত ২ জানুয়ারি রাতে লালমনিরহাট পৌরসভার কোটতলী এলাকায় সমন্বয়ক গোলাম আজমের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
৩ জানুয়ারি রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নূরুল ইসলাম শহীদকে মারধরের অভিযোগ করা হয়েছে। লাঠিসোঁটা ও রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয় তাঁকে। আহত ওই সমন্বয়ককে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
গত ১৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক শেখ ফরাশকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে।
শেখ ফরাশ জানান, ওই দিন সন্ধ্যায় তিনিসহ কয়েকজন শহরের আকুরটাকুরপাড়া ওয়াফেল টাইমের সামনে বসেছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে পাঁচ-সাতটি মোটরসাইকেলে দুর্বৃত্তরা গিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায়।
গত ২০ জানুয়ারি দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা অডিটরিয়ামে ‘ঘটনা প্রবাহ, চলমান সংকট ও নিরসন, আজকের প্রজন্ম ও আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক মতবিনিময়সভায় যোগ দিয়েছিলেন সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি। সেখানে আবদুল্লাহ আল হামিদ নামের একজন পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। তিনি ছাত্রলীগ ও সেন্ট্রাল বয়েজ অব রাউজানের সদস্য বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ২১ জানুয়ারি রাজধানীর বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিসে সমন্বয়কদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে সাতজন আহত হন।
গত ২৩ জানুয়ারি পাবনার ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের সামনে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলায় সমন্বয়ক ইব্রাহিম হোসেন আহত হন। ইব্রাহিম হোসেন ঈশ্বরদী পৌর শহরের পূর্ব টেংরি এলাকার আবদুস সালামের ছেলে। তিনি পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
গত ২৪ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে নাদিম ইসলাম রোহান নামের এক সমন্বয়ককে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে আরেক সমন্বয়কের বিরুদ্ধে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, আগামী ৩০ জানুয়ারি আশুগঞ্জ শ্রম ও কল্যাণ কেন্দ্রে তারুণ্যের মেলায় আসার কথা জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ মাহাদি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লহর। কিন্তু মিসেল নামে সোহাগপুর এলাকার এক সমন্বয়ক তাঁদের আশুগঞ্জ তারুণ্যের মেলায় আসার বিষয় নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ মেসেঞ্জারে প্রতিহতের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে নাদিম ইসলাম রোহান প্রতিবাদ করলে সোহাগপুর গ্রামের মিসেলের নেতৃত্বে একদল যুবক রোহানকে পিটিয়ে আহত করে। পরে তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে আশুগঞ্জ, পরে ঢাকায় পাঠানো হয়। এ ঘটনার পর উত্তেজিত জাতীয় নাগরিক কমিটির আশুগঞ্জ উপজেলার সদস্যরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জ গোলচত্বর এলাকা অবরোধ করেন।
গত ২১ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সংগঠক মোহাইমিনুল ইসলাম শিহাবের বাড়ির দেয়ালে লাল কালিতে লেখা হয় ‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’।
সমন্বয়করা যা বলছেন : গতকাল কালের কণ্ঠের কথা হয় কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, একের পর এক হামলার ঘটনায় তাঁরা উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যেও বিভক্তি রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। বিভিন্ন কারণে নিজেদের মধ্যে দূরত্বও তৈরি হচ্ছে। তবে তাঁদের নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথাও জানিয়েছেন তাঁরা।
কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তছলিম ইসলাম অভি কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি চক্র দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পরিবেশ ঘোলা করতে চাইছে। প্রশাসনে গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের দোসররা রয়ে গেছে। যে কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এই সমন্বয়ক বলেন, ‘যেভাবে হামলার ঘটনা ঘটছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। অনেকে পেছন থেকে ইন্ধন দিচ্ছে। আমাদের দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আমরা চেয়েছিলাম মানুষের নিরাপত্তা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখবে সরকার। কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা।’
গতকাল বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানায়, ‘আমরা লক্ষ করেছি, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এ ধরনের হামলা-ছিনতাইসহ নানা ন্যক্কারজনক ঘটনা চলমান, যা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলের মতোই জনমতে ভয় ও শঙ্কা তৈরি করছে। দেশের সব নাগরিককে নিরাপদ রাখা ও বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সুতরাং চব্বিশের শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই সরকারকেই সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে।