ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া মেহজাবীন, তাঁর ভাই বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ ১৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা সরিয়েছেন। ই-অরেঞ্জ ও প্রতিষ্ঠানটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবে এ টাকা জমা, হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন, স্থানান্তর ও রূপান্তর করে অর্থপাচার অপরাধ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
উচ্চ আদালতে দাখিল করা আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের অপেক্ষায় আছে।
একই রিট আবেদনে গত ৭ এপ্রিল ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ওঠা গ্রাহক ঠকানো, টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিএফআইইউকে তদন্ত করে চার মাসের মধ্যে এ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। ই-অরেঞ্জ থেকে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার দাবি করে ৫৪৭ গ্রাহকের পক্ষে ছয় গ্রাহকের করা রিট আবেদনে রুলসহ এ আদেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
আদেশ অনুযায়ী, বিএফআইইউ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুদকের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
আদালতে বিএফআইইউর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শামীম খালেদ, দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এ কে এম ফজলুল হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। আর রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম লিটন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মানিক কালের কণ্ঠকে বলেন, সিআইডির প্রতিবেদনটি দাখিলের জন্য আদালত থেকে সময় নিয়েছি।
কাল (আজ বৃহস্পতিবার) তা উপস্থাপন করা হবে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদন : এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের নামের ১৩টি ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করা হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত চলে এ লেনদেন। এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ১১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা জমা এবং এক হাজার ১০৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। জমা ও উত্তোলন মিলে মোট দুই হাজার ২২১ কোটি ৪২ লাখ টাকার লেনদেন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সেখানে বলা হয়, সোনিয়া ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমানের নামে ২৪টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করা হয়েছে। ওই ২৪ হিসাবের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি প্রায় ১২০ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন।
সিআইডির অনুরোধে ই-অরেঞ্জসংশ্লিষ্ট সব ব্যাংক হিসাব গত বছর ২৫ জুলাই স্থগিত করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ই-অরেঞ্জের মালিকানায় সোনিয়া মেহজাবিন থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা পরিবর্তন করে তাঁর ভাই পুলিশ কর্মকর্তা (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানার স্ত্রী নাজনীন নাহার বিথির নামে হস্তান্তর করা হয় ই-অরেঞ্জের মালিকানা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান, মেহজাবিনের ভাই শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ নগদে টাকা উত্তোলন ছাড়াও ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাব থেকে মোট ১৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা স্থানান্তর বা উত্তোলন করেন। অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করার পরও গ্রাহকদের কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ না করে গ্রাহকের টাকা তাঁদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলনের পাশাপাশি সে টাকা দিয়ে ব্যক্তিগত স্থায়ী সম্পদ কিনেছেন, যা প্রতারণার শামিল।
অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ২(শ)(৫) ধারা অনুসারে প্রতারণা অপরাধ। কাজেই অপরাধলব্ধ আয় এসব ব্যাংক হিসাবে জমা, উত্তোলন, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্থপাচার অপরাধ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
সিআইডির প্রতিবেদন : ঢাকা মহানগর এলাকায় ১১টি মামলার উল্লেখ করে এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব মামলা ই-অরেঞ্জসংশ্লিষ্ট প্রতারণা ও অর্থপাচারের অপরাধের জন্য করা হয়েছে। ১১টি মামলার মধ্যে ৯টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। দুটি মামলা তদন্তাধীন।
এসব মামলার পর্যালোচনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ও সত্তা পরস্পর যোগসাজশে ক্রয়াদেশ বাবদ অগ্রিম নেওয়া টাকা ব্যাংক হিসাবে স্থান্তরের মাধ্যমে সোনিয়া মেহজাবিন, মো. মাসুকুর রহমান ও মো. আমান উল্লাহ চৌধুরী মোট ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ তিন হাজার ৭৬৮ টাকা পাচার করেছেন। এসব মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁরা এখন কারাগারে আছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাবে প্রচুর টাকা জমা হয়। ই-অরেঞ্জসহ অভিযুক্ত ব্যক্তি ও সত্তার ১৩টি ব্যাংক হিসাবে ৬৭৫ কোটি ২৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩৫ টাকা উত্তোলন এবং ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩০৭ টাকা স্থিতি থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
এ ছাড়া ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাবে কবে কত টাকা জমা হয়েছে, কে কত টাকা উত্তোলন, স্থানান্তর ও রূপান্তর করেছেন, সন-তারিখ উল্লেখ করে এর বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
এসব মামলার পর্যালোচনায় প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত সত্তা ব্যবহার করে অভিযুক্তরা প্রতারণার মাধ্যমে সংঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে অর্থপাচারের চেষ্টা করেছেন, যা অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মামলাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংক হিসাব বিশ্লেষণ এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি ও সত্তার সব তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে শিগগিরই তদন্তকাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে সিআইডির প্রতিবেদনে।