ফলে ভোরের পর সিত্রাংয়ের প্রভাব ক্রমে কমে যাবে। দেশের উপকূলে এবং অন্যান্য অঞ্চলেও আজ ভারি বৃষ্টিসহ ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
গতকাল রাত ১০টায় ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান জানিয়ে মনোয়ার হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপত্সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলা এবং ওই এলাকার দ্বীপ ও চরগুলোকেও ৭ নম্বর বিপত্সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ও কক্সবাজার উপকূল এবং সেখানকার চর ও দ্বীপগুলোকে ৬ নম্বর বিপত্সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে আবহাওয়া দপ্তর থেকে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মূলত ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাস তুলনামূলক কম হওয়ায় এর গতিমুখ বারবার দিক পরিবর্তন করায়, ঝড় উপকূলের নিকটবর্তী হওয়ার বেশ আগ থেকে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় এবং উপকূল এলাকায় তাপমাত্রা কমে যাওয়া ও ভাটার সময় ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানতে শুরু করায় এটি দুর্বল হওয়ার আভাস দিচ্ছিল। আঘাত হানার সময়ও ঘূর্ণিঝড়ের গতি আইলা বা সিডরের মতো প্রবল ছিল না।
তবে প্রাথমিক আঘাতের তীব্রতা ও জলোচ্ছ্বাসের ধরন বলছে, অবকাঠামোগত ক্ষতি ও কৃষির ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে উপদ্রুত অঞ্চলে।
গতকাল রাত ১১টার দিকে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনের পুরো এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। ভোলার মনপুরায় বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। পটুয়াখালী ও বরগুনার নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। লক্ষ্মীপুরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে।
ক্ষয়ক্ষতি
গতকাল দুপুরে নড়াইলের লোহাগড়ায় ঝড়ে গাছের ডাল পড়ে মর্জিনা বেগম (৪০) নামের এক গৃহপরিচারিকার মৃত্যু হয়েছে। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নে গাছ চাপা পড়ে মনির নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন চরফ্যাশন থানার ওসি মোহাম্মদ মোবাদ হোসেন। এ ছাড়া দৌলতখান উপজেলায় একজন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
মোবাইল ফোন কম্পানিগুলোর সাড়ে ৯ হাজার টাওয়ার অচল হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি মোবাইল অপারেটররা।
লঞ্চ ও তিন বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরে উড্ডয়ন-অবতরণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব গন্তব্যের নির্ধারিত ৬০টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গতকাল সন্ধা ৭টা পর্যন্ত দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শাহজালালে নামতে না পেরে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, আজ দুপর পর্যন্ত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশালের যে নির্ধারিত ফ্লাইট ছিল, সেগুলোর সূচি পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
বৈরী আবহাওয়ায় জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে বিআইডাব্লিউটিসি পরিচালিত সব ফেরিঘাট বন্ধ রাখা হয়। আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়া সাপেক্ষে ফেরি সার্ভিস পুনরায় চালু করা হবে বলে জানিয়েছে বিআইডাব্লিউটিসি। সারা দেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, এরই মধ্যে কক্সবাজারে এক লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। এসব মানুষ এ অঞ্চলের কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়ার নিচু এলাকা থেকে এসেছে। কক্সবাজারে গতকাল ৬ নম্বর বিপত্সংকেত ছিল।
সরকারের প্রস্তুতি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিত্রাংয়ের ক্ষতি মোকাবেলায় সাত হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে ২৫ লাখ মানুষের আশ্রয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রায় ৭৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। প্রয়োজনীয় খাবার, নগদ টাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন বলে গতকাল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
নৌবাহিনীর ১৭টি জাহাজ প্রস্তুত
ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তার জন্য চট্টগ্রাম, খুলনা ও মোংলায় নৌবাহিনীর ১৭টি জাহাজ, দুটি মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট (এমপিএ) এবং দুটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্গত এলাকাগুলোতে মোতায়েনের জন্য নৌ কন্টিনজেন্টও প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
কৃষি বিভাগের ছুটি বাতিল
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল এবং সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব এলাকায় আমন ধান ৮০ শতাংশ পেকেছে, সেগুলো কাটার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে জরুরি ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
তিন বিভাগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়কবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানও বন্ধ থাকবে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা)