জথীন্দ্র আরিয়াপালা
শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ শুনতে কালের কণ্ঠ কথা বলেছে দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-ত্রিনকোমালির (সিএসএসটি) নির্বাহী পরিচালক জথীন্দ্র আরিয়াপালার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান
কালের কণ্ঠ : শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য দায়ী কে?
জথীন্দ্র আরিয়াপালা : অবশ্যই এটি শাসনব্যবস্থার সমস্যা। বর্তমানে শ্রীলঙ্কা মূলত এর শাসক সিংহল-সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারগুলোর ভুলের ফল ভোগ করছে। বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার জন্য কে দায়ী—প্রশ্ন করলে বলব, পুরো সিংহল রাজনীতিই দায়ী।
বিজ্ঞাপন
কালের কণ্ঠ : কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকে তো চীনের ঋণের ফাঁদের কথা বলছেন।
জথীন্দ্র আরিয়াপালা : চীন এলটিটিই এবং শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধকে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের শেষ
পর্যায়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে অস্ত্র সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। এই সুযোগটিই কাজে লাগায় চীন। এই প্রেক্ষাপটে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও চীনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জোরালো হয়। রাজাপক্ষে শেষ পর্যন্ত বেইজিংপন্থী হয়ে ওঠেন।
এই পটভূমিতে ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছিল। নির্বাচনে পরাজিত মাহিন্দা রাজাপক্ষেও তাত্ক্ষণিকভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-কে দোষারোপ করেন। নতুন সরকার ঘোষণা করেছিল, তারা শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করবে। কিন্তু বিষয়গুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। চীনের ঋণ কলম্বোর গলা চেপে ধরেছে। এই প্রেক্ষাপটে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হাম্বানটোটা বন্দরটি একটি চীনা কম্পানিকে ৯৯ বছরের ইজারায় দেওয়া হয়েছিল। এটা চীনের ঋণ-ফাঁদ কূটনীতির সাফল্য বলে মনে হচ্ছে। চীনের ঋণ-ফাঁদ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু চীন বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। আমি বলব, এটি মূলত শ্রীলঙ্কার রাজনীতির সমস্যা, চীনের সমস্যা নয়। কোনো দেশ বিনা মূল্যে বা বিনা লাভে বিদেশিদের সামনে খাবারের থালা সাজিয়ে দেয় না।
কালের কণ্ঠ : শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা থেকে অন্য দেশগুলো কী শিক্ষা নিতে পারে?
জথীন্দ্র আরিয়াপালা : শ্রীলঙ্কা একটি ছোট উন্নয়নশীল দেশ। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা শুধু শ্রীলঙ্কার মতো দেশের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যদি একটি জাতি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল না হয়, তবে সেই দেশ যে পদক্ষেপই নেয় না কেন, শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। শ্রীলঙ্কা এর চমৎকার উদাহরণ।
১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। পরের বছর শ্রীলঙ্কার আরেকটি জাতিগোষ্ঠী ইলম তামিলরা ফেডারেল দাবি পেশ করে, যা পরবর্তী সময়ে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে বিকশিত হয়। কিন্তু সিংহল শাসকগোষ্ঠী তামিল জাতিগত ইস্যুকে দূরদর্শিতা নিয়ে দেখেনি। তারা নিপীড়নের নীতি অনুসরণ করেছিল। ফলে দেশটি গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে। ফলে পুরো দেশই ধার করে বাঁচতে থাকে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঠিকমতো না সামলানোর কারণে ভারত ও পশ্চিমাদের চাপে পড়ে যায় দেশটি। ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপও প্রকাশ্য হয়। তার পরও শাসকরা এ থেকে শিক্ষা নেননি। একটি বহু জাতি-গোষ্ঠীর দেশ কেমন হওয়া উচিত নয়; আজ শ্রীলঙ্কা তার উদাহরণ হয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সন্নিবেশে থাকা দেশগুলো কিভাবে পরিচালনা করা উচিত এবং সেখানে কী কী করা উচিত নয়; আজ তার একটি অবশ্য পাঠ্যের নাম শ্রীলঙ্কা।
কালের কণ্ঠ : এই পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ কী?
জথীন্দ্র আরিয়াপালা : শ্রীলঙ্কা যদি একটি ভালো ভবিষ্যৎ দেখতে চায়, তাহলে এই দুটি বিষয় একই সঙ্গে ঘটতে হবে। শ্রীলঙ্কা এখন পর্যন্ত যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করেছে, তা অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে সংশোধন করতে হবে। সিংহল রাজনীতিকে শ্রীলঙ্কার জাতিগত সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। তা না হলে শ্রীলঙ্কা সংকটের কেন্দ্র হয়েই থাকবে।
কালের কণ্ঠ: আপনাকে ধন্যবাদ।
জথীন্দ্র আরিয়াপালা : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।