<p>নরসিংদীর মাধবদী পৌর এলাকার দুটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল বুধবার পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন এই অভিযান চালায়।</p> <p>পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকাসহ আরো কয়েকটি অপরাধে জিয়াং সু জিং ডিং স্টোরেজ কম্পানি লিমিটেডকে দুই লাখ টাকা এবং পেং ইউ কম্পানি লিমিটেডকে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিনাত ফৌজিয়া। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক প্রশান্ত কুমার রায়।</p> <p>শুধু এ দুই কারখানা নয়, নরসিংদী জেলার বিভিন্ন ব্যস্ত, জনাকীর্ণ ও জনবসতিপূর্ণ স্থানে অন্তত ১১টি ব্যাটারি তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে; যার মধ্যে ১০টিরই পরিবেশ অধিপ্তরের ছাড়পত্র নেই। নামে ব্যাটারি তৈরির কারখানা হলেও এগুলোতে নিয়মিতই পোড়ানো হয় সিসা। আর সিসা পুড়িয়ে বানানো হয় ব্যাটারির প্লেট।</p> <p>নরসিংদীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা ব্যাটারি কারখানাগুলো হলো শিবপুর উপজেলার পুরানদিয়া এলাকার এশিয়া কার বিডি লিমিটেড, রায়পুরা উপজেলার মরজাল এলাকার এশিয়া ব্যাটারি লিমিটেড, মাধবদী পৌর এলাকার জিয়াং সু জিং ডিং স্টোরেজ কম্পানি লিমিটেড, মাধবদীর রাইনাদী এলাকার বিএও নাং পাওয়ার টেকনোলজি লিমিটেড, পলাশ উপজেলার পারুলিয়া এলাকায় জিন উয়েন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পানি লিমিটেড ও সিং উয়ান স্টোরেজ লিমিটেড, চিনিশপুর ইউনিয়নের বাদুয়ার চর এলাকার চিশতিয়া ব্যাটারি সার্ভিসিং, শীলমান্দি ইউনিয়নের খাটেহারা এলাকায় শিংসুন ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, কবিরাজপুর এলাকায় ফেইলং লেড কম্পানি লিমিটেড এবং নুরালাপুর ইউনিয়নের ছোট রামচন্দ্রী এলাকার মেসার্স সানশাইন মেটাল রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।</p> <p>সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এশিয়া কার বিডি লিমিটেড, শিংসুন ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই গড়ে ওঠা কারখানাগুলো বিদ্যালয়, বাসস্ট্যান্ড ও বাজার লগোয়া জনাকীর্ণ স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে। এসব কারখানার বেশির ভাগ মালিকই হচ্ছেন চীনের নাগরিক। তাঁরা স্থানীয় ব্যক্তিদের জমি বা স্থাপনা ভাড়া নিয়ে এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন।</p> <p>এর মধ্যে এশিয়া কার বিডি লিমিটেডের কারখানাটি ২০১৪ সালে পুরানদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি জানতে পেরে সেখানে হাজির হন স্থানীয় অর্ধশতাধিক বাসিন্দা ও পুরানদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হোসাইন মো. মোস্তফা মোল্লা ও প্রধান শিক্ষক নাদিরা আফরোজ। পরে তাঁরা ব্যাটারি কারখানা থেকে নির্গত সিসাযুক্ত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যের প্রভাবে পরিবেশ ও সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা তুলে ধরে এর প্রতিকার চান। কারখানাগুলো উচ্ছেদেরও দাবি জানান তাঁরা।</p> <p>পুরানদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাদিরা আফরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্কুলের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে এই ব্যাটারির কারখানাটি করা হয়েছে। কারখানা থেকে যখন-তখন সিসাযুক্ত কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। আর এই ধোঁয়ার ঝাঁজালো গন্ধে শিক্ষার্থীদের মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।’</p> <p>কারখানাগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা জানায়, বায়ুদূষণের কারণে হাজারো মানুষ, স্থানীয় পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এলাকার প্রতিটি ঘরে চোখের অসুখ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগবালাই লেগে আছে।</p> <p>এলাকাবাসীর অভিযোগ, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে জমিতে ফসল হচ্ছে না, গাছে ফল ধরে না এবং পুকুরেও মাছ বাঁচতে পারছে না। ব্যাটারির কারখানা থেকে এসিডমিশ্রিত বর্জ্য পানি ও সিসাযুক্ত ছাই ছড়িয়ে পড়ছে উন্মুক্ত পরিবেশে। এলাকার টিনের চালা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।</p> <p>পুরানদিয়া বাজারের দোকানদার আবদুর রহিম বলেন, ‘মিলের পাশ দিয়ে যাতায়াতের সময় চোখের মধ্যে আঠালো কণাজাতীয় কিছু এসে পড়ে। দীর্ঘদিন চোখ জ্বালাপোড়াসহ অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। এ পর্যন্ত আমি তিনবার এ সমস্যার মুখে পড়েছি।’</p> <p>নরসিংদী জেলা সিভিল সার্জন ডা. নুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যাটারি তৈরির কারখানা এবং সেখানে পোড়ানো সিসার কালো ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ব্যাটারির বর্জ্য পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে তা আশপাশের মানুষের শরীরে প্রভাব ফেলে। এর ফলে মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন হতে পারে। হতে পারে ত্বকের নানা রোগ।</p> <p>এ বিষয়ে জানতে চাইলে এশিয়া কার বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চায়নিজরা কারখানাটি পরিচালনা করে। আমি বাকি দিকগুলো দেখাশোনা করি। জেলা, উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে।’ তবে কাগজপত্রগুলো দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে অস্বীকৃতি জানান।</p> <p>এক গবেষণায় দেখা যায়, সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ শিশু। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। ইউনিসেফ ‘দ্য টক্সিক ট্রুথ : চিলড্রেনস এক্সপোজার পলিউশন আন্ডারমিন্স এ জেনারেশন অব পটেনশিয়াল’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন জানায়, বিশ্বজুড়ে প্রতি তিন শিশুর একজন বা প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম বা তারও বেশি। এই শিশুদের প্রায় অর্ধেকের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে আনুমানিক তিন কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম।</p> <p>নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান  বলেন, ‘এসব ব্যাটারি কারখানা পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে। তাই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’</p> <p>তিনি জানান, নরসিংদীর শিবপুরের এশিয়া কার বিডি লিমিটেডকে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সদর দপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখা সাত লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত কারখানাটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। পাশাপাশি কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।</p> <p> </p>