নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া ও নীলফামারী প্রতিনিধি
২৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ | পড়া যাবে ৫ মিনিটে
নীলফামারীতে লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত শ্রমিক মিনারার স্বামীর আহাজরি। ছবি : কালের কণ্ঠ
মিনারা বেগম ও আরমান আলী দম্পতির স্বপ্ন ছিল ছেলে মুন্নাকে লেখাপড়া শেখাবেন, মানুষের মতো মানুষ করবেন। বড় হয়ে সে দায়িত্ব নেবে পরিবারের। তখন মা-বাবার হাড়ভাঙা শ্রমের অবসান ঘটবে। মিনারা ইপিজেডে শ্রমিকের কাজ নিয়েছিলেন।
বিজ্ঞাপন
নীলফামারীতে একটি অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে গতকাল বুধবার একটি ইজি বাইকে ট্রেনের ধাক্কায় মিনারাসহ (৩০) উত্তরা ইপিজেডের চার নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সকাল ৭টার দিকে জেলা সদরের সোনারায় ইউনিয়নের দারোয়ানী রেলস্টেশনের কাছে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন ইজি বাইকচালক ও আরো তিন নারী শ্রমিক। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত অন্য তিনজন হচ্ছেন—শেফালী বেগম (৩৫), রুমানা বেগম (৩৫) ও সাহেরা বানু (৩৫)। হতাহতদের বাড়ি সোনারায় ইউনিয়নের ধনীপাড়া ও কোনারীপাড়া গ্রামে। শ্রমিকরা ইজি বাইকে চড়ে উত্তরা ইপিজেডে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। ওই নারীদের মৃত্যুতে অন্ধকার নেমে এসেছে চার পরিবারে।
মাস দেড়েক আগেই নীলফামারী সদরের বৌবাজার মনসাপাড়া গ্রামে অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল।
এলাকাবাসী জানায়, গতকাল সকালে ঘন কুয়াশার মধ্যে একটি অটোরিকশায় করে সাত নারী শ্রমিক বাড়ি থেকে উত্তরা ইপিজেডের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। দারোয়ানী রেলস্টেশনের কাছে একটি অরক্ষিত লেভেলক্রসিং পার হওয়ার সময় খুলনা থেকে চিলাহাটিগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। এতে যাত্রীসহ অটোরিকশাটি কয়েক ফুট দূরে ছিটকে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ট্রেনে কাটা পড়ে ইটভাটা শ্রমিক আশরাফ হোসেনের স্ত্রী শেফালী বেগমের (৩৫) মৃত্যু হয়।
এলাকাবাসীর সহায়তায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আহত ছয় শ্রমিক ও অটোরিকশাচালককে উদ্ধার করে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে ধনীপাড়া গ্রামের মোশারফ হোসেনের স্ত্রী রুমানা, কোনারীপাড়া গ্রামের বেলাল হোসেনের স্ত্রী সাহেরার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে হোটেল শ্রমিক আরমান আলীর স্ত্রী মিনারা মারা যান।
ধনীপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের স্ত্রী মিনা বেগম (৩৫) ও নজরুল ইসলামের স্ত্রী রওশনারা বেগমকে (২৭) নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে এবং অটোরিকশাচালক অহিদুল ইসলাম (২৪) ও সাহেদ আলীর স্ত্রী কুলসুম বেগমকে (৩০) রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার নিহত শ্রমিকদের গ্রামে গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম। একই সঙ্গে চারজনের মৃত্যুতে শোকাহত গ্রামবাসীর সহযোগিতায় চলছিল চারটি লাশ দাফনের প্রস্তুতি।
আহাজারি করতে করতে মিনারার স্বামী আরমান আলী (৩৫) বলছিলেন, ‘মোর সব শ্যাষ হয়া গেল। এলা মুন্নাক মুই লেখাপড়া শিখাইম কেমন করি। ’
আরমানের ছোট ভাই ইমান আলী বলেন, ‘প্রতিদিন ছেলের জন্য স্কুলে যাওয়ার টাকা দিয়ে ভাবি ইপিজেডের চাকরিতে যান। আজকেও তাই করেছেন। কে জানে ছেলেকে এতিম করে বাড়িতে ফিরে আসবেন লাশ হয়ে। ’
দারোয়ানী রেলস্টেশন এলাকার কৃষক হাচিনুর রহমান জানান, লেভেলক্রসিংটি অরক্ষিত থাকায় সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। দেড় বছর আগে পারাপারের সময় সেখানে ট্রেনে কাটা পড়ে একজনের মৃত্যু হয়। গত ১০ বছরে ক্রসিংটিতে অন্তত পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটার কথা জানান তিনি।
নীলফামারী সদর থানার উপপরিদর্শক বাকিনুর ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, সৈয়দপুর রেলওয়ে থানা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
সৈয়দপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাস্থলে একজন, নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে দুজন এবং রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে একজনসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ’
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর সকালে নীলফামারী সদরের বৌবাজার মনসাপাড়া গ্রামে ট্রেনে কাটা পড়ে রিকশাচালক রোজয়ান আলীর মেয়ে আক্তার (৭), শিমু (৪) ও ছেলে মমিনুরের (৩) মৃত্যু হয়। তাদের বাঁচাতে গিয়ে সালমান ফারাজী শামীম (৩০) নামের এক যুবক মারা যান।
কাহালুতে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণি চিকিৎসক নিহত
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, বগুড়ার কাহালুতে ট্রেনের ধাক্কায় মতিউর রহমান মিন্টু নামের এক পল্লী প্রাণী চিকিৎসক মারা গেছেন। মতিউর কাহালু উপজেলার মুরইল মাস্টারপাড়ার মৃত আব্দুল ওহাব চুনুর ছেলে। গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুরইল ইউনিয়নের বেলঘরিয়া নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানায়, মতিউর মোটরসাইকেলে করে রেলগেট পার হচ্ছিলেন। এ সময় বগুড়া থেকে সান্তাহারগামী দোঁলনচাপা আন্ত নগর ট্রেনের ধাক্কায় তিনি ছিটকে পড়েন। স্থানীয়রা তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন ।
কাহালু থানার ওসি আমবার হোসেন জানান, লাশ পরিবারের সদস্যরা দাফনের জন্য নিয়ে গেছেন।