<p>র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে দেশের ভাবমূর্তির। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও অর্থ দপ্তর গত শুক্রবার তাঁদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ বলে অভিযোগ তুলেছে।</p> <p>নিষেধাজ্ঞা আরোপের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারকে গতকাল শনিবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ক্ষোভ ও হতাশা জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহ্মুদ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা।</p> <p>র‌্যাব নিয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার এনজিওগুলো আগে থেকেই সমালোচনা করছিল। ২০১৮ সালে সংশোধিত ‘লেহি আইনের’ আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশ থেকে র‌্যাবের প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ করে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর প্রতি সহযোগিতা সীমিত করতে লেহি আইন প্রয়োগ করা হয়।</p> <p>আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা উইকিলিকসের ফাঁস করা নথি অনুযায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাজ্যও ২০১১ সালে র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, র‌্যাবের সঙ্গে গত এক দশকে পশ্চিমা দেশগুলোর সহযোগিতার সম্পর্ক ক্রমেই সীমিত হয়েছে। এ কারণে এবার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে মূল ক্ষতি হবে দেশের ভাবমূর্তির। এ ছাড়া মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে এমন দেশের কাতারে ফেলা হতে পারে বাংলাদেশকে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সমমনা আরো কিছু দেশ একই পদক্ষেপ নিতে উত্সাহিত হতে পারে। এখন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে নিষিদ্ধ বাহিনী ও ব্যক্তিদের সহযোগিতা পাওয়া আরো কঠিন হবে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ থাকলে বাজেয়াপ্ত হবে। এ ছাড়া তাঁরা আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও অর্থ ব্যবস্থাতেও নানা ধরনের জটিলতার মধ্যে পড়তে পারেন।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত হওয়ার পর এটি সবচেয়ে বড় ধাক্কা। এর ফলাফল যাই হোক না কেন, তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। কেননা, এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কার্যত মিয়ানমার ও ইরানের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান এক টুইটবার্তায় জানান, নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বাংলাদেশের র‌্যাবের সঙ্গে যারা স্থান পেয়েছে তারা চীন, উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গী হিসেবে থাকা ঢাকার জন্য ভালো নয়।</p> <p>আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরাও প্রায় একই কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত হয়তো বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলবে না। আমরা কোনো সংকটে পড়তে যাচ্ছি না। তবে নিষেধাজ্ঞা কেন দিল সে বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া দরকার।’</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের দূতকে তলব করে যা বলেছে সরকার : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে গতকাল সকালে তলব করেছিলেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আগে থেকে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে এমন এক তরফা ঘোষণায় বাংলাদেশ হতাশ। যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেগুলো নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।</p> <p>পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সরকারের যে সংস্থাটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেই সংস্থা দুই দেশের অভিন্ন অগ্রাধিকার সন্ত্রাস, মাদক চোরচালান ও আন্তর্দেশীয় ঘৃণ্য অন্যান্য অপরাধ মোকাবেলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।</p> <p>সচিব বলেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট যে ঘটনাগুলোর অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলোর জবাবাদিহি ও বিচারসংক্রান্ত তথ্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকেই শুধু নয়, একাধিকবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাঠামোগুলোর কাছেও বাংলাদেশ ব্যাখ্যা করেছে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এমন কিছু দেশের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশের কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যে দেশগুলোতে জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আক্ষরিক অর্থেই জাতিগত নির্মূলের মতো গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ করেছে।</p> <p>পররাষ্ট্রসচিব যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ‘নেমিং অ্যান্ড শেমিং’ (কারো নাম উল্লেখ করে চিহ্নিত করা ও লজ্জা দেওয়া) কাউকে অপদস্ত বা পরাজিত করার অভ্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অভ্যাস ছেড়ে আলোচনা, সম্পৃক্ততা ও সমন্বয়ের পথ অনুসরণ কর উচিত। বিশেষ করে, আগামী বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী ঘিরে বিদ্যমান সম্পর্কের মাত্রা ও ব্যাপ্তি আরো জোরদার করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে বলেন, বাংলাদেশের ক্ষোভ ও হতাশার কথা তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে জানাবেন। রাষ্ট্রদূত মনে করেন, আলোচনা ও উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে চমত্কার বহুমুখী সম্পর্ক আরো জোরালো হতে পারে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং : যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, জনগণের আস্থার প্রতীক ও সুশৃঙ্খল একটি বাহিনী এবং তার প্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং। কেউ ভালো কাজ ও উন্নতি করলে ঈর্ষা থেকে অনেক সময় তার ওপর আক্রমণ বেশি হয়।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ছয় লাখ লোক নিখোঁজ এবং পুলিশের গুলিতে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, এগুলোর জন্য কেউ নিষিদ্ধ হয় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেমন হবে তা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে।</p> <p>অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, অতিরঞ্জিত সংবাদের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পুলিশ কখনো বিচারবহির্ভূত হত্যা করে না।’</p> <p>স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা চ্যালেঞ্জিং। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো সেই দায়িত্ব সুন্দরভাবেই পালন করছে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে সেই ঘটনা একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে তদন্ত করা হয়। তদন্তে কোনো গাফিলতি ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।</p> <p>মোদির বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা ছিল : তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহ্মুদ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রেই মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। পরে তাঁকেই আবার লালগালিচা অভ্যর্থনা দিয়েছে, যা প্রমাণ করে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর।</p> <p>অন্যদিকে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ বলেছেন, ‘র‌্যাব কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না, সব সময় মানবাধিকার রক্ষা করে আসছে। মানুষের অধিকার রক্ষা করাই র‌্যাবের প্রধান দায়িত্ব। আমরাই (র‌্যাব) বড় মানবাধিকারকর্মী।’</p> <p>সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ খুব চিন্তায় পড়ে যাবে—এমন অবস্থায় কিন্তু বাংলাদেশ নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নতি যত হবে, ততই ঝামেলা বাড়বে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া দরকার।</p>