<p>ব্রিটিশ ভারতবর্ষে নানা কারণে বাঙালি মুসলমানের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপট অবস্থা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এমনকি ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায়ও বটে। হয়তো তাই রাজনৈতিক উচ্চ মতাদর্শের চেয়ে যেকোনো মূল্যে আত্মোন্নয়ন ও আত্মপ্রতিষ্ঠা তার কাছে প্রধান হয়ে উঠেছিল। আর সে কারণে জিন্নাহর যুক্তিহীন দ্বিজাতিতত্ত্ব (হিন্দু-মুসলমান ভিত্তিক) দুই হাতে আঁকড়ে ধরতে তার বাধেনি। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল তার প্রমাণ। অথচ উত্তর-পশ্চিম মুসলমান ভারতে এই নির্বাচনের ফলাফল ছিল ভিন্ন ও বিপরীত ধারার।</p> <p>তাই সিদ্ধান্তে আসতে হয়, প্রথমত পাকিস্তান বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন হয়ে ওঠে; দ্বিতীয়ত বাঙালি মুসলমানের ভোটে পাকিস্তান অর্জিত হয় ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে এবং ভারত বিভাগে; সেই সঙ্গে বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাব বিভাজনের রক্তস্রোত বেয়ে।</p> <p>কিন্তু উল্লিখিত স্বপ্ন বাস্তবের পথ ধরেনি, বরং বিপরীত ধারায় হাঁটতে থাকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বমুহূর্ত থেকেই। পাকিস্তানের মূল নায়ক চতুর আইনজীবী রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এক সুরে বলতে থাকেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। পাকিস্তানি মৌতাতে আচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমান এই রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়নি, ব্যতিক্রম দু-চারজন রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিজীবী—শিক্ষক, সাংবাদিক ও লেখক। পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিমে বৈষম্যের সূচনা রাষ্ট্রভাষা থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘিরে এবং তা গোটা পাকিস্তানি শাসনামলে মূলত কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও সামরিক শক্তির কল্যাণে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে সোচ্চার হয় রাজনীতিসচেতন বাঙালি ছাত্র-যুবা শ্রেণি। ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে। প্রতিবারই উপলক্ষ তৈরি করে পাকিস্তানি শাসকরা। তাঁদের বক্তৃতা, বিবৃতি এবং গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে ভূমিকা বাঙালি ছাত্র-যুবাদের আন্দোলনে মাঠে নামতে বাধ্য করে, যেমন ১৯৪৮-এর মার্চে, তেমনি ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।</p> <p>১৯৪৮-এর সংক্ষিপ্ত আন্দোলন মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলাকেন্দ্রিক হলেও ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি তথা একুশের আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে। প্রমাণ একুশের স্লোগানগুলো। এ ক্ষেত্রে শুধু ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ক্ষান্ত হয়নি ছাত্র-যুবা-জনতা। তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত স্লোগান, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, যা ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতীক। সেই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’।</p> <p>শেষোক্ত গুরুত্বপূর্ণ স্লোগানটির অর্থ হলো জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে যেমন উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা ও উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা। একুশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত আন্দোলনের বিস্তার এবং সর্বশ্রেণির মানুষের (শ্রমজীবীসহ) তাতে অংশগ্রহণ। একুশের সর্বজনীন চরিত্র এর সফলতার মূল কারণ।</p> <p>দুই. প্রচণ্ড দমননীতির মুখে এবং ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে অন্তত ১২ জন ছাত্র-জনতা শহীদ হওয়ার কারণে আন্দোলন দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতা পিছু হটে না। একুশের আন্দোলন জাতিকে চিরায়ত কয়েকটি প্রতীক উপহার দেয়—প্রথমত রফিক-জব্বার-বরকত প্রমুখের আত্মদানে চিহ্নিত ‘শহীদ দিবস’ একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ‘শহীদ দিবস অমর হোক’ এই স্লোগানের ভিত্তিতে শহীদ দিবস অমর করতে নির্মিত শহীদ মিনার, যা পরে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণে পরিণতি লাভ করে।</p> <p>শহীদ মিনার শুধু ঢাকায় মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণেই তৈরি হয়নি, সারা দেশে প্রধানত শিক্ষায়তনে নির্মিত হয়। শাসক শ্রেণি যতবার শহীদ মিনার ভেঙেছে, ততবারই তা নতুন করে গড়ে উঠেছে। শহীদ দিবস ও শহীদ মিনার স্থায়ী আসন পেয়ে গেছে দেশের ছাত্র-যুবা-জনতার হূদয়ে। এই প্রতীক দুটি ছিল শোক, প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেরণার স্থায়ী উৎস। বছরের পর বছর ‘শহীদ দিবস’ পালিত হয়ে আসছে শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে। এসব কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেসকো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য গর্ব ও অহংকারের বিষয়।</p> <p>জাতীয় জীবনে গুরুত্বের কারণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সৃষ্টি নানামাত্রিক একুশে সাহিত্য, চলেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা এখন চিরায়ত ঐতিহ্যে পরিণত, সেই সঙ্গে বইমেলা। একুশে বাঙালির জীবনকে জড়িয়ে আছে একটি মহীরুহের মতো, তার ডালপালা ও পত্রপুষ্পের বিস্তারে। এসব বিচারে ‘মহান একুশে’ ফেব্রুয়ারি তুলনাহীন।</p>