আলী যাকেরের সঙ্গে আমার থিয়েটারের জীবন শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। প্রথমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তারপর ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ নাটকের মহড়ায়। তখনই আমাদের মধ্যে সংকল্প হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হলেই আমরা নিয়মিত থিয়েটার চর্চা করব। সার্বক্ষণিক থিয়েটার চর্চা করব।
দেশ স্বাধীন হলো ডিসেম্বরে। আমরা ফিরে এলাম ডিসেম্বরের শেষে। ফেব্রুয়ারিতেই আরণ্যক নাট্যদল সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে সদ্য শহীদ মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘কবর’ দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আলী যাকের সেখানে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করলেন।
নির্দেশনা দিলাম আমি। ১৯৭৩ সালে তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দিলেন। নাগরিকে যোগ দেওয়ার পর একের পর এক তাঁর নির্দেশনা ও অভিনয়ে দলটি বিপুলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠল।
মঞ্চনাটক যাঁরা করেন তাঁরা ভালো করেই জানেন, যাঁরা নির্দেশক থাকেন নাটকে তাঁরা আসলে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। যে অভিযানে নির্দেশক হচ্ছে সেনাপতি। দলের শৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর মতো। কিন্তু মননে চিন্তাশীল। থিয়েটারের যাঁরা পরিচালক তাঁদের কত যে ইতিহাস জানতে হয়; কত ধরনের আচরণ জানতে হয়; কত ধরনের গবেষণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; সেটা দর্শক অনুভব করেন যখন নাটকটি দেখেন। আমরা যখন ষোড়শ শতাব্দীর নাটক করি, শেকসপিয়রের অথবা ক্রিস্টোফার মার্লোর, তখন সেই সময়টিকে অনুধাবন করা, অথবা যখন গ্যালিলিওকে নিয়ে নাটক করি তখন গ্যালিলিওর সময়টাকে ধরা এবং ধরতে গেলে যে গবেষণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা অত্যন্ত কষ্টকর পথচলা। কিন্তু তৃপ্তি সেখানেই, যেখানে দর্শক বলে ফেলে—হ্যাঁ, এটাই তো সত্যি। এই যে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য অবিরাম চেষ্টা করা, সেই অবিরাম চেষ্টার একজন মানুষ আলী যাকের। তিনি পাঁচটি নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। যেমন—গ্যালিলিও, শাহজাহান, দেওয়ান গাজীর কিস্সা, ম্যাকবেথ ও টেমপেস্টের মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
একটি দলে যাঁরা নেতৃস্থানীয় মানুষ থাকেন তাঁদের নির্দেশনা, অভিনয় বা সৃজনশীল কাজের বাইরেও অনেক কাজ করতে হয়। সেই কাজগুলোকে গুছিয়ে এনে কস্টিউম, সংগীত, প্রোপস থেকে শুরু করে নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। তারপর আমাদের দেশে রয়েছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। সেইখানে টাকা জোগাড় করাটাও একটি কঠিন কাজ। এগুলো করে, আমরা যাঁরা নির্দেশনা দেই এবং একই সঙ্গে অভিনয় করি; তাঁদের আবার মহাসংকট। সবার অভিনয় ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কি না দেখা, তারপর নিজের অভিনয়টাও ঠিকঠাক মতো মঞ্চে করা। এটাও একটা কঠিন কাজ। সেই কাজটিও আলী যাকের অত্যন্ত সুচারুরূপে সারাজীবন করে গেছেন।
আজকে বাংলাদেশের যে নাট্যচর্চা, যেটা অনেকেই বলেন, স্বাধীনতার সোনালি ফসল হচ্ছে নাটক। কিন্তু সেই সোনালি ফসলের পরিচর্যা করা এবং তাকে একটি ঈপ্সিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে রাষ্ট্রীয় তাগিদ দরকার, সেটা কিন্তু ছিল না। তারপর আমরা যখন কাজ শুরু করেছিলাম, আলী যাকের যখন মঞ্চে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন এ দেশে মঞ্চ ছিল না। মহিলা সমিতি, গাইড হাউস, ব্রিটিশ কাউন্সিল—এসব জায়গা খুঁজে খুঁজে আমরা অভিনয় করেছি। সে এক কঠিন কাজ বটে। সেই কঠিন কাজটির জন্য যে উদ্যম এবং যে সাহস প্রয়োজন ছিল, সেটা আলী যাকেরের মধ্যে ছিল শতভাগ। কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি।
আলী যাকেরের একটা ফোকসভাগেন গাড়ি ছিল। সেই গাড়ি নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। বিভিন্ন সংকট মোকাবেলা করে একেকটি নাটক নামাতে হতো। আমাদের গাড়ি ছিল না। রিকশায় চড়ে, হেঁটে, কর্মীদের নিয়ে কত ধরনের সংকট মোকাবেলা করে বাংলাদেশের নাটককে একটি জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজকে যে নাটক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আলী যাকেরের যে ভূমিকা; শুধু বাংলাদেশের নাটক বলব না, বাংলা নাটকে তাঁর যে অবদান-ভূমিকা, সেটা অবিস্মরণীয়। তাই দর্শকের স্মৃতিতে আলী যাকের বেঁচে থাকবেন অনেক দিন। আর নাট্যকর্মীদের কাছে একটি প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন যত দিন বাংলাদেশে থিয়েটার থাকবে তত দিন।
যাঁরা গত হন, বিগত হন না; তাঁদেরই একজন আলী যাকের।
লেখক : বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
অনুলিখন : আজিজুল পারভেজ
মন্তব্য