<p>করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশ এক মাস ধরে লকডাউনে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শিল্প মালিকদের সংগঠনগুলোকে তিন ধাপে শিল্প-কারখানা খুলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রবিবার খুলেছে কিছু পোশাক কারখানা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলার কথা থাকলেও আংশিক মানা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। কোনো কোনো কারখানায় আবার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয়নি। তবে শ্রমিকদের মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস পরে কারখানায় ঢুকতে হয়েছে। শ্রমিক নেতারা জানান, কারখানা এলাকায় যেসব শ্রমিক আগে থেকে আছেন, তাঁরাই গতকাল কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ময়মনসিংহ, ভালুকা, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল থেকে কিছু শ্রমিক গত শনিবার রাতেই রাজধানীতে ফেরেন।</p> <p>এদিকে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, ৮৫৮টি কারখানার কর্তৃপক্ষ আবেদন করলেও কয়টি কারখানা খুলেছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি তারা। বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ১০ থেকে ১২টি কারখানা খোলা হয়েছে। এসব কারখানাকে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।</p> <p>শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এক হাজার ৪২৭টি কারখানা খোলা হয়েছে। বিজিএমইএ, টিএমইএ, বিকেএমইএ, বেপজাসহ গতকাল এক হাজার ৪২৭টি কারখানা খোলা ছিল। শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে তাদের আওতাধীন রয়েছে সাত হাজার ৬০২টি কারখানা। এখনো ৬৫০টি কারখানায় শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করা হয়নি।</p> <p>শ্রমিকদের সংগঠন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন  জানিয়েছে,  ঢাকার সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় ৪৫০টি কারখানা খোলা হয়েছে। গাজীপুরে পাঁচ শতাধিক, চট্টগ্রামে ১৩০ এবং উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান এবং তুরাগে ৩০টির বেশি কারখানা খুলেছে।</p> <p>রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি কারখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমরা গেটে ঢুকতেই হাত ধুতে বলা হয়। এ ছাড়া গেটে ঢুকে যে গেটকিপার তাপমাত্রা মাপেন তিনি কোনো সুরক্ষার পোশাক পরেননি। তবে কারখানার ভেতরে একটি মেশিন বাদ দিয়ে আমাদের বসানো হয়েছে। মাস্ক, হাতমোজা দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>রাজধানীর মিরপুরের সোটেক্স গার্মেন্টসের আরেক  শ্রমিক জানান, তাদের কারখানায় সাত শতাধিক শ্রমিক কাজ করতেন। এর মধ্যে ৩০০ শ্রমিক কাজ করছেন। তিনি বলেন, সামাজিক দূরত্ব মেনে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে শ্রমিকদের ঢোকানো হয়েছে।</p> <p>গার্মেন্টস শ্রমিক  ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি এবং এটা মানা কঠিন। মেশিনে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়। তিনি আরো বলেন, ঢাকার  ভেতরে খুব কম কারখানা খুলেছে, যেগুলো খোলা সেগুলো আগে থেকেই খোলা ছিল।</p> <p>শ্রমিক নেতা সিরাজুল হক রনি বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশের আনুমানিক ১০ শতাংশ কারখানা গতকাল খোলা হয়েছে। এসব কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও শ্রমিকরা যাতায়াতের পথেই সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা বেশি। শ্রমিকরা সামাজিক সুরক্ষার নির্দিষ্ট দূরত্ব না মেনেই কারখানায় যাতায়াত করছেন। এ জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।</p> <p>সাভার-আশুলিয়ায় খুলেছে দেড় শতাধিক পোশাক কারখানা : সাভার থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাসহ (ডিইপিজেড) সাভার ও আশুলিয়ার বেশ কিছু পোশাক কারখানা গতকাল খুলে দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকরা ভেঙে ভেঙে ছোট ছোট যানবাহনযোগে সাভার-আশুলিয়ায় এসেছেন। সকালে সাভারের উলাইল, হেমায়েতপুর, আশুলিয়ার বারইপাড়া, চারাবাগ, বাইপাইল, জিরানী, নবীনগর, কাঠগড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বড় বড় গ্রুপের পোশাক কারখানা খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।</p> <p>শিল্প পুলিশ-১ সাভার-আশুলিয়া জোনের পরিচালক পুলিশ সুপার সানা শামিমুর রহমান জানান, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে এক হাজার ৮০০ শিল্প-কারখানায় প্রায় আট লাখ শ্রমিক কাজ করেন। পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) তৈরিসহ জরুরি শিপমেন্ট থাকায় গতকাল ১৩০টি কারখানা চালু করা হয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, সাভার-আশুলিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো কারখানা আংশিক খোলা হয়েছে। তবে কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের উপস্থিতি কম। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা লাইন করে ঢোকার সময় স্প্রে মেশিনের নিচ দিয়ে যেতে হচ্ছে। আর বড় বড় কারখানায় প্রতিটি লাইনের একটি করে মেশিন গ্যাপ দিয়ে শ্রমিকদের বসানো হয়েছে। তবে শ্রমিকরা আসা-যাওয়া করার সময় যে পরিবহন ব্যবহার করছেন, সেখানে মোটেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।</p> <p>এদিকে ঢাকার আশুলিয়ায় নরসিংহপুরের সিগমা ফ্যাশনসের ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। গতকাল সকাল থেকে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক কারখানার সামনে ও ভেতরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। গত শনিবার কারখানাটির ৭০৯ শ্রমিককে লে অফের মধ্যে ছাঁটাইয়ের নোটিশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে বকেয়া বেতনের দাবিতে সাভারের হেমায়েতপুরে স্কেল ফ্যাশনস, সামাইর এলাকায় সততা অ্যান্ড এমব্রয়ডারি প্রিন্ট লিমিটেড এবং দোসাইদ এলাকায় রক ফ্যাশন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন।</p> <p>গাজীপুরে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশনা : গাজীপুর থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বিজিএমইএর সিদ্ধান্ত ছাড়াই লকডাউনের মধ্যে গাজীপুরে গতকাল সাড়ে ৪০০ গার্মেন্ট খুলেছে। অল্প কয়েকটি ছাড়া প্রায় সব কারখানায় উপেক্ষিত ছিল সরকারের স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশনা। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ঠেলাঠেলি করে শ্রমিকদের কারখানায় ঢুকতে ও বের হতে দেখা গেছে। মাস্ক থাকলেও ছিল না গ্লাভস। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানার ভেতরে তাঁরা আগের মতোই কাজ করেছেন। ছিল না সুরক্ষা ব্যবস্থা। এতে করোনাভাইরাস আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে অধিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে গাজীপুর।</p> <p>এদিকে গাজীপুরে আজও বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন আটলানটেক্স, ব্রাইট অ্যাপারেলস, স্টাইলক্রাপ্ট, স্টাইলিস্ট, হেছন বিডিসহ কয়েকটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা। কোথাও কোথাও মহাসড়ক এবং কোথাও আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা।</p> <p>নারায়ণগঞ্জে অনেক শ্রমিককে দেওয়া হয়নি পিপিই, মাস্ক : আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত নারায়ণগঞ্জে গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট কারখানা সীমিত আকারে খোলা হয়েছে। এসব কারখানার শুধু নিটিং, ডায়িং ও স্যাম্পল সেকশন খোলা থাকবে। তবে কিছু নিয়ম ও শর্ত মেনে গার্মেন্ট খোলার কথা বলা হলেও এর ব্যতিক্রম হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু পোশাক কারখানা চালুর দিনে শ্রমিকদের জ্বর মাপা, মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা শর্ত পূরণ করলেও কিছু কারখানা এসবের ধারেকাছেও ছিল না। শ্রমিকদের সরবরাহ করা হয়নি পিপিই কিংবা মাস্ক। গতকাল ফতুল্লার পঞ্চবটি বিসিক শিল্পাঞ্চলে এবং সিদ্ধিরগঞ্জের ইপিজেডে বেশ কিছু গার্মেন্ট চালু হয়েছে। বিসিক শিল্পাঞ্চলের ৩০ শতাংশ পোশাক কারখানা গতকাল চালু হয়েছে। মূলত যেসব শ্রমিক ছুটির পরও নারায়ণগঞ্জেই অবস্থান করছিলেন, তাঁদের নিয়েই গার্মেন্টগুলো সচল করা হয়।</p>