<p>পরীক্ষাগারে নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে সঠিকভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করলেই একটি রোগের ধরন ও কারণ শনাক্ত করা সম্ভব। আর এর ওপর ভিত্তি করে সঠিক চিকিত্সা প্রদান এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব। এর সঙ্গে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হার রোধ করাও সম্ভব।</p> <p>প্রশ্ন হচ্ছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কিভাবে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা যায়? বেশ কিছু পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে আরটি-পিসিআর, যা জিনতত্ত্ব সম্বন্ধীয়। এখানে ভাইরাসের আরএনএ-কে পরিপূরক ডিএনএ-তে রূপান্তর করে নির্দিষ্ট প্রাইমারের সাহায্যে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। নমুনার জন্য গলা থেকে লালা, নাকের সর্দি, কফ বা থুতু, কোনো ক্ষেত্রে ফুসফুস থেকে উপাদান সংগ্রহ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেও আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে এই পরীক্ষারও কিছু দুর্বলতা আছে, যেমন আরটি-পিসিআরের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাইরাল আরএনএ যুক্ত উচ্চমানের নমুনার উত্স দরকার। এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কারণ ভাইরাল আরএনএর পরিমাণ শুধু রোগীদের মধ্যেই প্রচুর পরিমাণে পরিবর্তিত হয় না, এটি পরীক্ষার সময় এবং সংক্রমণের শুরু বা লক্ষণগুলোর শুরুর ভিত্তিতে একই রোগীর মধ্যেও পরিবর্তিত হতে পারে। পর্যাপ্ত ভাইরাল আরএনএ ছাড়া আরটি-পিসিআর নেতিবাচক ফল দিতে পারে। সর্বোপরি নমুনা থেকে আরএনএ আলাদা করার ধাপগুলো জটিল এবং পিসিআর সঞ্চালনের জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন। এই আধুনিক মলিকুলার পদ্ধতির জন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র দরকার, যেটি বাংলাদেশের বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বহু আগে থেকেই আছে।</p> <p>তার মানে আমাদের দেশেও কিন্তু এ ধরনের রোগের সঠিকভাবে পরীক্ষা করার সুব্যবস্থা আছে; আছে পরীক্ষার ক্রমাঙ্ক নির্ণয়  (Calibration) করার মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ। খুব আশাবাদের কথা যে সরকার এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরটি-পিসিআরনির্ভর করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছে।</p> <p>এখন আসি অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিজেননির্ভর ডটস্পট পদ্ধতির কথায়। এই পরীক্ষায় রক্তরস ব্যবহার করা হয়। একটি জীবাণু (অ্যান্টিজেন)—যেমন ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশের পর অভিযোজিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ফলে</p> <p>IgM নামক অ্যান্টিবডি (প্রাথমিক অ্যান্টিবডি) তৈরি হয় এবং কিছুদিন পরে তৈরি হয়  IgG অ্যান্টিবডি, যাকে সেকেন্ডারি অ্যান্টিবডি বলে।</p> <p> IgM অ্যান্টিবডি তৈরি হতে গড়ে সময় লাগে সাত দিন, শিখরে পৌঁছে ২১ দিনে।</p> <p>IgG অ্যান্টিবডি তৈরি হতে গড়ে সময় লাগে ১৪ দিন। জীবাণুর ধরনের ওপর অ্যান্টিবডিগুলো তৈরির সময়ের তারতম্য হয়ে থাকে।</p> <p>IgM শরীরে দু-তিন মাসের বেশি থাকে না; কিন্তু  IgG অ্যান্টিবডি অনেক দিন থাকে, যা সারা জীবনও থাকতে পারে। এ কারণে একটি জীবাণুর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কোর্স সম্পন্ন করলে পরে আর ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।</p> <p>এখন বিষয় হলো, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর IgM  ও  IgG অ্যান্টিবডিগুলো তৈরি হতে কত দিন সময় লাগে? চীনে ১৭৩ জন রোগীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্ত রোগীর মধ্যে লক্ষণ প্রকাশের ১১ দিনের মাথায় আর ফিনল্যান্ডে ৯ দিনের মাথায় করোনা নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। জার্মানিতে ৯ জন রোগীর মধ্যে ৫০ শতাংশ অ্যান্টিবডি তৈরি হতে সময় লেগেছে সাত দিনের মতো। অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে অবশ্যই শনাক্ত করা সম্ভব করোনার অস্তিত্ব; কিন্তু এর জন্য লক্ষণ প্রকাশের পর আরো অপেক্ষা করা প্রয়োজন। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশের ১০ দিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সুতরাং লক্ষণ প্রকাশের পর অ্যান্টিবডি তৈরি হতেই যদি গড়ে ৯ থেকে ১০ দিন সময় লেগে যায় এবং এর মধ্যে একজন ব্যক্তি যদি টেস্টে নেগেটিভ হয়, তাহলে সে নিশ্চিন্ত মনে তার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকবে, তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে মেলামেশা করবে, যা ব্যাপক হারে কমিউনিটিতে এই ভাইরাস বিস্তারে অনেক সহায়ক হবে।</p> <p>বর্তমানে করোনা মহামারির বিস্তার রোধে এবং ল্যাবরেটরি টেস্টের অপ্রতুলতার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের  Point-of-Care (POC) immunodiagnostic tests for COVID-19  পরীক্ষাপদ্ধতির প্রচেষ্টা সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাধুবাদ জানিয়েছে। সঙ্গে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, এই টেস্ট শুধু গবেষণাকাজে ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু রোগ সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। বর্তমানে রোগীদের শনাক্তের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিজেন/অ্যান্টিবডি শনাক্তকারী দ্রুত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলো ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে না; যদিও কার্য সম্পাদন, সম্ভাব্য ডায়াগনস্টিক ইউটিলিটি, রোগের নজরদারি এবং মহামারিসংক্রান্ত বা এপিডেমিওলজিক্যাল চর্চাক্ষেত্রে গবেষণায় তাদের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে গবেষণা অত্যন্ত উত্সাহিত করা হচ্ছে।</p> <p>সুতরাং অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডিনির্ভর পরীক্ষাটি প্রাথমিক শনাক্তকরণে কতটুকু ফলপ্রসূ হতে পারে তার সন্দেহ থেকেই যায়, যা আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন রাখে এবং রোগের সময়ের সঙ্গে পরীক্ষার সময়ের সামঞ্জস্য থাকাটাও খুবই জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (সিডিসি) প্রধান ড. রবার্ট রেডফিল্ডের মতে, ভাইরাসের পুনরায় উত্থান হলে এই পরীক্ষাপদ্ধতি বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষভাবে কার্যকর হবে। তা ছাড়া আরটি-পিসিআর প্রাথমিক পরীক্ষাপদ্ধতি হিসেবে অ্যান্টিজেন/অ্যান্টিবডিনির্ভর ডটস্পট পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। তাহলে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে আমরা কোনটি গ্রহণ করব। দ্রুত শনাক্তের জন্য আরটি-পিসিআরনির্ভর, নাকি অ্যান্টিজেন/অ্যান্টিবডিনির্ভর ডটস্পট পদ্ধতি।</p> <p>এই বন্দিদশা আমরা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারব না। হতদরিদ্ররা অতিকষ্টে দিন পার করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে তার গতি হারিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার অবশ্যই লকডাউন শিথিলের চিন্তাভাবনা করবে আর এটিই স্বাভাবিক। তবে শৈথিল্যের আগে আমাদের অবশ্যই ব্যাপক হারে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা খুব প্রয়োজন। এত পরীক্ষা জরুরি কেন? ছোট্ট একটি উদাহরণে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। গত ৬ মার্চ ইতালির ছোট শহর ভিওতে করোনার লক্ষণ নেই এমন ব্যক্তিসহ তিন হাজার ৩০০ জন বাসিন্দাই দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যখন পরীক্ষা শুরু হয়েছিল তখন কমপক্ষে ৯০ জন করোনায় আক্রান্ত ছিল। এই বিস্তৃত পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্তদের আলাদা করা হয়েছিল। ১৮ মার্চ সেখানে আর নতুন রোগী শনাক্ত হয়নি।</p> <p>দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদেরই করোনা পরীক্ষার সংখ্যা সর্বনিম্ন। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৮৮ জনের অর্থাত্ প্রতি লাখে ৯ জনের, যা ৯ এপ্রিল ছিল মাত্র দুজন। অর্থাত্ আমাদের সক্ষমতা আছে। আবার শুধু সংখ্যা বাড়াতে গিয়ে সঠিক পরীক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আমরা যেন আপস করে না বসি। দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করে তাদের আলাদা রেখে বাকিদের সুস্থভাবে কাজকর্ম স্বভাবিক রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ব্যাপকভাবে পরীক্ষা এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া এবং প্রতিবেশী দেশের কেরালা রাজ্যে অনেক সুফল নিয়ে এসেছে।</p> <p>আমাদের দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনি করোনার পরীক্ষাকে আর্থিক প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ জারি করুন যেন এই বিশাল জনগোষ্ঠী নামমাত্র মূল্যে বা বিনা পয়সায় পরীক্ষা করাতে পারে এবং এই প্রক্রিয়ায় আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাহলে হয়তো এ দেশের মানুষ বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। </p> <p>লেখক : অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।</p>