<p>কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে বাড়িতে ঢুকে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। টাস্কফোর্সের মাদকবিরোধী অভিযানে গত শুক্রবার মধ্যরাতে শহরের চড়ুয়াপাড়ার বাড়ি থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেছেন, জোর করে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিতে পারেন না। মাদকবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের কথা বলা হলেও ওই অভিযানে একমাত্র সাংবাদিক রিগানকে ছাড়া আর কাউকে আটক করা বা সাজা দেওয়া হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে মানববন্ধন করেছেন। </p> <p>রিগানের সহকর্মীরা বলেছেন, জেলা প্রশাসক ও প্রশাসনের অনিয়মের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার কারণে প্রতিশোধমূলকভাবে ধরে এনে সাজানো মামলায় তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।</p> <p>মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাঠ প্রশাসন) গাফফ্ার খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে রংপুরের বিভাগীয় কমিশন তদন্ত করছে। আগামীকাল (আজ রবিবার) এ বিষয়ে তারা একটি প্রতিবেদন দেবে। তার ওপর ভিত্তি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p> <p>কী ঘটেছে : বিবিসি বাংলা সাংবাদিক রিগানের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতুর সঙ্গে কথা বলে জানায়, তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য কুড়িগ্রাম কারাগারে গেলে কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানিয়েছে, তাঁর স্বামীর সঙ্গে কারো দেখা না করতে দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তাই তিনি দেখা করার অনুমতি পাননি।</p> <p>তবে পরে রিগানের ভাই কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন বলে জানা গেছে।</p> <p>মোস্তারিমা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘শুক্রবার রাত ১২টার দিকে অনেক লোকজন এসে আমাদের বাসার দরজা খুলে দিতে বলে। একপর্যায়ে ওনারা ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সাত-আটজন মিলে আমার স্বামীকে মারতে শুরু করে। তাদের হাতে রাইফেল, পিস্তল সবই ছিল। তখন বারবার বলছিল, কয়দিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছিস। গুলি করে দেব। বলে আর মারে। সারা রাস্তা মারতে মারতে নিয়ে গেছে।’ তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেছেন, রাত ১টার দিকে তাঁরা জানতে পারেন রিগানকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁকে মাদকের মামলায় এক বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।</p> <p>প্রশাসন দাবি করেছে, রিগানের বাড়ি থেকে ৪৫০ মিলিলিটার দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।</p> <p>ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে সে দোষ স্বীকার করায় এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’</p> <p>প্রতিশোধমূলক সাজা? : স্থানীয় সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, আটককৃত সাংবাদিক রিগান এর আগে স্থানীয় জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সংবাদ করেছিলেন। এ নিয়ে কিছুদিন ধরে তাঁকে নতুন আর কোনো সংবাদ না করার জন্যও বলা হয়েছিল।</p> <p>বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আরিফুল ইসলাম রিগান জেলা প্রশাসকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সংবাদ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কাবিখার টাকায় একটি পুকুর সংস্কার করে জেলা প্রশাসক নিজের নামে নামকরণ করেছিলেন। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের মোবাইল কোর্টকে যেভাবে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তা নিয়েও তিনি সংবাদ করেছিলেন। আরেকটি খবরের বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। সে কারণেই তাঁকে এভাবে আটক করে সাজা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রিগানের বাড়িতে কোনো তল্লাশি চালানো হয়নি। কিন্তু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে মদ আর গাঁজা উদ্ধারের গল্প বলা হচ্ছে। অথচ সে সিগারেটও খায় না। এ থেকেই বোঝা যায়, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আর প্রতিশোধমূলকভাবে করা হয়েছে।’</p> <p>যা বলছেন জেলা প্রশাসক : কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘টাস্কফোর্সের নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিধি-বিধান অনুসরণ করে সাজা দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমাদের নিয়মিত মোবাইল কোর্ট হয়, আমরা শিডিউল করে দিই। অনেক সময় তারা মাদক, চোরাচালানের টাস্কফোর্সের অভিযানেও যায়, যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন। গত রাতেও এ রকম কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। সেই অভিযানে ওই ব্যক্তিকে আটক করে সাজা দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের কারণে এই অভিযান বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেই প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘যদি ওই ঘটনাই হতো, সেটা তো এক বছর আগের কথা। এখানে আমি কিছু কাজ করেছি, সংস্কারকাজ... সেখানে ওরা বলছে যে আমার নামে.... নামের কোনো লক্ষণই নেই, সেটা আলাদা বিষয়, সেখানে সে স্যরি বলেছে বলে আমরা তো আর কিছুই বলি নাই। ওইটা যদি কোনো বিষয় হতো, তাহলে তো তখনই আমরা কোনো অ্যাকশনে যেতাম। এখন ওইটার সঙ্গে এইটা মেলাচ্ছে তারা (সাংবাদিকরা)।’</p> <p>ভ্রাম্যমাণ আদালত এভাবে অভিযান চালাতে পারে কি না জানতে চাইলে সুলতানা পারভীন বলেন, ‘আসলে অভিযানটি চালিয়েছে টাস্কফোর্স। সেখানে যদি মোবাইল কোর্টে শিডিউলভুক্ত মামলার বিষয় থাকে, সে ক্ষেত্রে তারা দিতে পারে।’</p> <p>কিন্তু যেভাবে একজন সাংবাদিককে মধ্যরাতে ধরে আনা, আধা বোতল মদ আর ১০০ গ্রাম গাঁজার মামলায় এক বছরের সাজা দেওয়া, এটা বেশ নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি তাই মনে করেন কি না—জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘টাস্কফোর্সের টোটাল টিম বলতে পারবে, আসলে ব্যাপারটা কী? আমি তো ঘটনাস্থলে ছিলাম না।’ রাতের ওই অভিযানে আর কাউকে সাজা দেওয়া হয়নি বলেও তিনি জানান। তাহলে কি শুধু একজনকে লক্ষ্য করেই অভিযান চালানো হয়েছে এবং তাঁকেই সাজা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে তা মনে হচ্ছে না। তবে আমার মনে হয় রেগুলার মামলা হলে ভালো হতো।’</p> <p>রিগানের স্ত্রী মোস্তারিমা বলেছেন, অভিযানের সময় তাঁর স্বামী কুড়িগ্রাম সদর থানায় ফোন করলে ওসি জানান, তাঁরা লোক পাঠাননি।</p> <p>অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য : রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, বাসা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিতে পারেন না। গাঁজা-মদ যদি ঘরে থেকেও থাকে, তবে তা নজরদারিতে রাখবে। এরপর যখন সময় হবে তখন তাঁকে মাদকদ্রব্যসহ আটক করবে। আর এসব মাদকদ্রব্য যদি কেউ লুকিয়ে রাখে, তাহলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তার নিজস্ব আইনবলে পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরো বলেন, তাদের (জেলা প্রশাসন) সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর যদি এ ধরনের সাজা দেওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ থাকে যে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে।</p> <p>প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাংবাদিক রিগানের ওপর যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই জেলা প্রশাসককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’</p> <p>তদন্ত শুরু : রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাংবাদিককে আটক ও সাজা দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আবু তাহের মো. মাসুদ রানাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি রাতের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন। আজ রবিবার সকালে প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।</p> <p>গতকাল দুপুরে কমিটি তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে আরিফুল ইসলামের শ্বশুর মোহাম্মদ আলী, মামা কুড়িগ্রাম পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম ও নূর ইসলাম, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।</p> <p>এ সময় নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, কারো প্ররোচনায় রিগানকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে কোনো সাক্ষ্য না নিয়ে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে। নুর ইসলাম অভিযোগ করেন, বাড়ির ফটক ও দরজা ভেঙে তাঁর ভাগ্নেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী বলেন, যে একটা সিগারেট খায় না, তাঁর বিরুদ্ধে মাদক মামলা দেওয়া দুঃখজনক।</p> <p>কুড়িগ্রামে মানববন্ধন : শহরের শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে রিগানের মুক্তি চেয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। সেখানে বক্তব্য দেন কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিপ্লব, সাংবাদিক রাজু মোস্তাফিজ প্রমুখ।</p> <p>আদালতের নজরে আনা হচ্ছে : আজ রবিবার ঘটনাটি হাইকোর্টের নজরে আনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। সুমন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি ক্ষমতা অপব্যবহারের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এটা আমলা দিয়ে তদন্ত করলে যথাযথ হবে না। আমি মনে করি এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।’ তিনি জানান, তাঁরা আদালতের কাছে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ চাইবেন। আদালত তাতে রাজি না হলে বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন অর রশীদ রিট আবেদন করবেন। এরই মধ্যে রিট আবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।</p> <p><strong>মধ্যরাতে সাংবাদিককে মোবাইল কোর্টে কারাদণ্ড বেআইনি : টিআইবি </strong></p> <p>সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে ঘর থেকে তুলে এনে মোবাইল কোর্টে বিচার করে কারাদণ্ড দেওয়ার পুরো ঘটনাকেই বেআইনি বলে আখ্যায়িত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল এক বিবৃতিতে সংস্থাটি দাবি করেছে, আইনের এমন যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ আইনের শাসনের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের পরিপন্থী এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর নামান্তর। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় দ্রুত তদন্ত এবং জড়িতদের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে প্রশাসন তথা সরকারের ওপরই জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে বলেও মন্তব্য করা হয় টিআইবির বিবৃতিতে।</p> <p> </p> <p> </p>