<p>‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বিনয়ী শুভেচ্ছা। দীর্ঘ চার বছর ক্ষমতা আমলে আপনি পারেননি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়কে কার্যকর করতে। এ আপনার হাজারো সফলতার মাঝে চরম ব্যর্থতা। আর এ জন্য আপনার পদত্যাগ করা প্রয়োজন। আমার শেষ আর্তি, অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করার পদক্ষেপ নিন। তা না হলে আমি আত্মহত্যা করব। এ অভিমান দেশবাসীর সাথে নয়, আপনার সাথেও নয়, আপনার ব্যর্থতার সাথে। ইতি—শেখ আবদুল আলিম।’</p> <p>শেখ হাসিনাকে এ কথাগুলো লিখে একটি ফ্যাক্স বার্তা পাঠিয়েছিলেন শেখ আবদুল আলিম। সেটা ২০০০ সালের ২৮ মের কথা।</p> <p>এরপর আবদুল আলিম সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর দাবিকে সমর্থন করেন এমন ১০০ জন মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করবেন। এ সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার না হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। প্রধানমন্ত্রীকে ফ্যাক্স পাঠানোর তিন দিনের মধ্যে ২২ জনের স্বাক্ষরও সংগ্রহ করেন; কিন্তু তিন দিনের মাথায় পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে থানায় নেয়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে অনেকটা জোর করেই আলিমের কাছ থেকে ‘আত্মহত্যা করবেন না’ মর্মে মুচলেকা নেওয়া হয়। তখন বিষয়টি সংবাদপত্রে উঠে আসে। পরে আলিম পণ করেন—বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচারের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি) খাবেন না। যেসব খাবার তৈরিতে ডিম ব্যবহৃত হয় সেগুলোও খাওয়া ছেড়ে দেন। আমিষ খাওয়া ছাড়ায় তিনি নানা শারীরিক সমস্যায় পড়েন, কিন্তু ‘ওয়াদা’ থেকে পিছপা হননি। ঈদে বাড়িতে কোরবানি পর্যন্ত দেননি। বাবা আমিষ খান না বলে তাঁর মেয়েও আমিষ খাওয়া ছাড়েন। প্রায় এক দশক পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার পর এলাকার লোকজন আনুষ্ঠানিকভাবে আবদুল আলিমকে আমিষে ফিরিয়ে আনে। বিষয়টি নিয়ে ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি ‘এবার আমিষ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ।</p> <p>আপাদমস্তক বঙ্গবন্ধুর ভক্ত শেখ আবদুল আলিমের (৬৩) বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুরে। জন্মস্থান ভারতের আসাম থেকে ১৯৬৫ সালে মা-বাবার সঙ্গে যান ময়মনসিংহের নান্দাইলে। ১৯৭০ সালে তাঁরা আসেন কালীগঞ্জে। চার সন্তানের জনক আলিম মুক্তিযুদ্ধের সময় জড়ান সাংবাদিকতায়। কালীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। এখন বৃদ্ধ বয়সে তাঁর শরীরে নানা রোগ ভর করেছে। এর পরও বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলেন একটি জাতীয় দৈনিকের কালীগঞ্জ প্রতিনিধি আলিম। স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিশুদের শোনার বঙ্গবন্ধুর কীর্তির কথা।</p> <p>ময়মনসিংহ থেকে লালমনিরহাট : ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে আলিম নান্দাইলের বাহাদুরপুর বাইলিটারেল হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তখন মামা আব্দুস সালামের কাছে বঙ্গবন্ধু, ছয় দফা আন্দোলনসহ ইতিহাস সম্পর্কে অনেক ধারণা নেন। ভালোবাসতে শুরু করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। ফলে তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ওই স্কুলে ১৭ শিক্ষার্থীকে নিয়ে গঠন করেন ছাত্রলীগের কমিটি। গোপনে চালান দলীয় কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণ সরাসরি শুনতে কয়েকজন মিলে ঢাকা যেতে বাড়ি থেকে অনেক দূর হেঁটে রেলস্টেশনে যান। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যেতে পারেননি। ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কারণে একসময় তাঁর বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে, আসতে থাকে হুমকি। কালীগঞ্জে চলে আসতে বাধ্য হন তাঁরা।</p> <p>যুদ্ধের প্রশিক্ষণ : পরে আলিম বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতীয় একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে গ্রেনেড চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর বাড়িতে এসে কিছুদিন থেকে চলে যান ভারতীয় ইয়ুথ ক্যাম্পে, কাজ করেন অস্ত্র পরিষ্কারের। সেখান থেকে যান পৈতৃক ভিটা আসামে। কিছুদিন পর বাড়িতে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতেন। কখনো রংপুরের প্রবীণ সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বাটুলের সম্পাদনায় ভারতের দিনহাটা থেকে প্রকাশিত রণাঙ্গন পত্রিকা দেশে এনে গোপনে বিতরণ করতেন।</p> <p>এখনো অনুভব করেন বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ : দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু আসেন রংপুরের বর্তমান সুরভী উদ্যান মাঠে। সেই জনসভায় যান আলিম। জীবনে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি গাড়িতে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আর দুই পাশে থাকা মানুষের সাথে করমর্দন করছিলেন। আমিও হাত বাড়িয়ে দিই। আমার সাথেও হাত মেলান তিনি। সেই স্পর্শ যেন আমি আজও অনুভব করি।’ কথাগুলো বলে কেঁদে ফেলেন আলিম।</p> <p>বাড়িতে অবরুদ্ধ : স্বাধীন দেশে সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়ান আলিম, যোগ দেন আওয়ামী লীগে। চাপারহাটে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও টাঙিয়ে রাখেন বঙ্গবন্ধুর ছবি। পঁচাত্তরে হঠাৎ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবর শুনে মানতে পারছিলেন না তিনি। শুরু করেন নানা পাগলামি। ভয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে পরিবারের লোকজন আলিমকে বাড়িতে এনে বেশ কিছুদিন অবরুদ্ধ করে রাখে।</p> <p>আলিম যা বললেন : আত্মহত্যা ও আমিষবিহীন থাকার বিষয়ে আলিম বলেন, ‘খুব অল্প বয়স থেকেই জাতির পিতাকে ভালোবাসতে শুরু করি। তাঁর হাত ধরে বাঙালির মুক্তি দেখেছি, বাংলাদেশ বিনির্মাণের শুরু দেখেছি। তাই তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা মেনে নিতে পারছিলাম না। আবার হত্যার বিচার তো দূরের কথা, উল্টো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। এসব মানতে পারিনি, তাই আমি আমার মতো প্রতিবাদ করেছি মাত্র।’</p> <p>মাফ নিয়ে মরতে চান : শেখ হাসিনাকে ফ্যাক্স বার্তা পাঠানোর ঘটনায় তিনি বলেন, ‘যদি মরার আগে সুযোগ পেতাম তাহলে নেত্রীর পায়ে হাত দিয়ে মাফ চাইতাম। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে তাঁর ব্যর্থতা ছিল না। এটা ছিল আইনের মারপ্যাঁচ। যা আমি পরে বুঝেছি।’</p> <p>শেখ আবদুল আলিমের সংসার চলে কোনো রকমে। ফলে চোখ ও পায়ের চিকিৎসা করাতে পারেন না। এর পরও ব্যক্তিগত চাওয়া নেই তাঁর, তিনি চান দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। তিনি বিশ্বাস করেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনার হাত ধরে বাস্তবে রূপ নেবে।</p> <p>কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বিজয় কুমার রায় বলেন, ‘আলিম এমন একজন মানুষ যিনি অন্ধের মতো ভালোবাসেন বঙ্গবন্ধুকে। যে কারণে জীবনে তাঁকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে।’</p>