<p>বহুল আলোচিত ঠিকাদার যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে কার ভুল ছিল, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ পরস্পরকে দায়ী করছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিপক্ষের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, অস্ত্র মামলায় শুনানিকালে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতেই উপস্থিত ছিলেন না। এই জামিন আবেদনের শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গুরুত্ব দেননি। আর তাঁরা শুনানিও করেননি। তবে জামিন নিয়ে বিতর্ক উঠায় হাইকোর্টের আলাদা দুটি বেঞ্চ জামিন প্রত্যাহার করেছেন।</p> <p>আদালত আদেশে বলেছেন, হাইকোর্টের কার্যতালিকায় জামিন আবেদনকারীর নামের বিভ্রাট থাকায় জামিন দেওয়া হয়েছিল। সেটি প্রত্যাহার করা হলো। গতকাল রবিবার হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আগের আদেশ প্রত্যাহার করে আদেশ দেন।</p> <p>ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নাসহ আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কারাবন্দি কোনো আসামির জামিনের আবেদন বা নিয়মিত জামিন আবেদনের ওপর রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য না শুনে জামিন দেন না আদালত। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় আইন অনুযায়ী আদেশ দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শোনা বাধ্যতামূলক।</p> <p>ওই আইনজীবীরা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ জানে না বলে যা বলা হচ্ছে, সেটি বলার সুযোগ নেই। তারা যদি না-ই জানে, তবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাঁরা আরো বলেন, আবেদন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এফিডেভিট করার পর কপি যদি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে সরবরাহ করা হয়ে থাকে আর যদি রাষ্ট্রপক্ষ আবেদনের বিরোধিতা না করে, তবে সেটি তাদের গাফিলতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আলোচিত জি কে শামীমের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, সেটি রাষ্ট্রপক্ষের তদন্ত করা উচিত। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেন, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘটনায় আদালত রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য না শুনেই জামিন বিষয়ে আদেশ দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করেন আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়ে থাকেন।</p> <p>আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে জি কে শামীমের জামিন বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে এরই মধ্যে কথা হয়েছে। তিনি বলেন, জামিন আবেদনের ওপর শুনানিকালে যদি রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থিত থেকে থাকে, তাহলে কেন বিরোধিতা করেনি, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরো বলেন, ‘আইনে স্পষ্ট বলা আছে, জামিনের ব্যাপারে দুই পক্ষকে শুনতে হবে। এখানে যদি এর ব্যত্যয় হয়ে থাকে, তাহলে সেটি দুঃখজনক।’</p> <p>জি কে শামীমের আইনজীবী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট ড. মমতাজউদ্দিন মেহেদী সাংবাদিকদের বলেন, জি কে শামীম হওয়ার কারণেই আজ জামিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আইনের যে ধারায় মামলা, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাস। এর মধ্যে চার মাসের বেশি কারাগারে রয়েছেন। এ রকম মামলায় যেকোনো ব্যক্তিরই জামিন হয়। তিনি বলেন, আদালত বিচার করবেন অপরাধের, অপরাধীর নয়। তিনি আরো বলেন, যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, তা লাইসেন্স করা। এটি মামলার এজাহারেই বলা হয়েছে। জামিন শুনানিকালে আদালত আইনের বই দেখেই জামিন দিয়েছেন। মমতাজউদ্দিন মেহেদী বলেন, শুধু জি কে শামীম হওয়ার কারণেই রাষ্ট্রপক্ষের মাথাব্যথা। তাই তাঁর জামিন নিয়ে এত কথা বলছে। তথ্য গোপন করে জামিন দেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আদালতে প্রকাশ্যে শুনানি হয়েছে। এরপর আদালত জামিন দিয়েছেন। তিনি বলেন, অস্ত্র মামলায় জামিন আবেদনের ওপর শুনানিকালে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফজলুর রহমান খান সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। আর সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মো. মাহমুদুল করিম রতন উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি কোনো কথা বলেননি। আসামি চার মাস ধরে কারাগারে আছেন, এটি শোনার পর আদালত জামিন মঞ্জুর করেন।</p> <p>তবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফজলুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, তথ্য গোপন করে অস্ত্র মামলায় জামিন নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আবেদনের কপি রাষ্ট্রপক্ষকে দেওয়ার কথা। তারা তা দেয়নি। তিনি আরো বলেন, আদালতের ওই দিনের কার্যতালিকায় জি কে শামীমের নাম স্পষ্ট করে লেখা হয়নি। জামিনের আবেদনে নাম আছে এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম। কিন্তু কার্যতালিকায় লেখা হয়েছে এস এম গোলাম। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ বুঝতে পারেনি এটি কার জামিনের আবেদন। তিনি বলেন, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে যে এজাহার করেছে পুলিশ, তাতেও জি কে শামীম লেখা হয়নি। এতেও বুঝতে অসুবিধা হয় যে এই মামলার আসামি আলোচিত জি কে শামীম কি না।</p> <p>আর মাদক মামলায় হাইকোর্টের যে বেঞ্চ জামিন দিয়েছিলেন, সেই আদালতে দায়িত্বরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌস রুপা সাংবাদিকদের বলেন, কার্যতালিকায় জি কে শামীম লেখা ছিল না। লেখা ছিল গোলাম কিবরিয়া। এ কারণে রাষ্ট্রপক্ষ বুঝতে পারেনি এটি কার জামিনের আবেদন। তবে জামিন আদেশ প্রত্যাহার হওয়ার পর তিনি বলেন, আদালত আগের জামিন প্রত্যাহার করেছেন। জামিনের বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করেছেন এবং জামিনের আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেছেন।</p> <p>মাদক মামলায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এবং অস্ত্র মামলায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ জি কে শামীমের জামিন মঞ্জুর করেন। শামীমকে মাদক মামলায় এক বছর এবং অস্ত্র মামলায় ছয় মাসের জামিন দেওয়া হয়। এই জামিনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, জামিনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কিছু জানে না। অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্যের পর জনমনে আরো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ওই দুটি আদালত গতকাল আলাদা আদেশ দিয়ে আগের দেওয়া জামিনের আদেশ প্রত্যাহার করেন।</p> <p>গতকাল প্রথমে অস্ত্র মামলায় শুনানি হয় বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে। শুনানিকালে আদালত বলেন, আবেদনকারীর নামের বিভ্রাট রয়েছে। এ কারণে জামিন দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। আদালত বলেন, আমি বিচারিক জীবনে বাংলা ভাই বা জেএমবির কোনো সদস্যকে জামিন দিইনি। আমি সন্ত্রাসীদের জামিন দিই না। রাষ্ট্রের স্বার্থেই আমি তাদের জামিন দিই না। আদালতে শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফজলুর রহমান খান বলেন, ‘আসামির নাম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। কিন্তু কার্যতালিকায় আছে এস এম গোলাম। এভাবেই তথ্য গোপন করা হয়েছে। আর আমাদের কোনো কপি দেওয়া হয়নি।’ ওই সময় আদালত জি কে শামীমের আইনজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমরা কার্যতালিকায় দেখছি আবেদনকারীর নামে বিভ্রাট আছে। তাই আমরা আগের আদেশ রিকল করছি। আদালত বলেন, এ ধরনের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য না শুনে জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই। এরপর আদালত আদেশ দেন।</p> <p>এর কিছুক্ষণ পর বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ মাদক মামলায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি দেওয়া জামিন প্রত্যাহার করে আদেশ দেন। </p> <p>প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জি কে শামীমের জামিনের আবেদন করার পর এর একটি কপি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। সেই কপি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা গ্রহণ করে গত ২৯ জানুয়ারি। ওই নথিতে লেখা আছে কোন আদালতে শুনানি হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আদালতে এর কোনো কপি সরবরাহ করা হয়নি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট দুটি আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলও কপি না পাওয়ার কথা বলেন আদালতে শুনানিতে।</p> <p>কার্যতালিকায় নামের বিভ্রাট কার কারণে হয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কার্যতালিকা ছাপানো হয় সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেস)। সেখানে যেভাবে তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে, সেভাবেই ছাপা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে সরবরাহ অনুযায়ী ছাপা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।  </p> <p>দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতন থেকে ধরা পড়েন জি কে শামীম। এর পরদিন তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়। ওই মামলায় নিম্ন আদালত জামিনের আবেদন খারিজ করার পর হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন জি কে শামীম।</p> <p> </p>