<p>হতে চেয়েছিলেন পুলিশ কনস্টেবল। জেলা পুলিশ লাইনসে কয়েকবার দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু উত্তীর্ণ না হওয়ায় চাকরি হয়নি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের এসএসসি পাস তরুণ কাজী আনিসুর রহমানের। সেই স্বপ্নভঙ্গের জ্বালা ও হতাশা যখন বুকে, তখন তাঁর ইচ্ছা জাগে ট্রেন দেখার। এই যন্ত্রযানটি তখনো তাঁর সচক্ষে দেখা হয়নি। ২০০১ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় আসেন ট্রেন দেখতে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন দেখতে গিয়ে রাজধানী শহরটাকে তাঁর ভালো লেগে যায়। ফলে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওঠেন একটি মেসে। এরপর জীবনের প্রয়োজনে চাকরি নেন গার্মেন্টে। বেশি পরিশ্রম করতে না পারায় কিছু দিন পর ওই চাকরি বদল করেন। যোগ দেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যুবলীগ নেতা হাবিবুর রহমান পবনের প্রাইভেট ফার্মে। সেখান থেকে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসা-যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে সেখানে ফাইফরমাশ খাটা, এর কিছুদিন পর কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি। পুলিশ কনস্টেবল হতে চাওয়া কাজী আনিসুর রহমানের ভাগ্য খুলে যায় যুবলীগ অফিসে এসে। এখন তিনি শতকোটি টাকার মালিক। শুধু তা-ই নয়, যাঁর পরিবারের সদস্যরা কখনো আওয়ামী লীগ রাজনীতির ধারেকাছে যায়নি, বিএনপিমনা বলে এলাকার লোকজন যাঁকে জানে, সেই আনিসুর রহমান এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সহযোগী সংগঠন যুবলীগের হর্তাকর্তা। দপ্তর সম্পাদক হলেও মূলত তিনিই এখন যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির চালকের ভূমিকায়।</p> <p>অর্থাত্ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নিয়ন্ত্রক তিনি।</p> <p>বিএনপি থেকে আসা যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় জুয়ার বোর্ডের একসময়ের তদারককারী যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নেওয়া একসময়ের ফ্রিডম পার্টির নেতা, পরবর্তী সময়ে বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি, বর্তমানে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি এনামুল হক আরমান (ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের ডান হাত), একসময় ফ্রিডম পার্টি ও পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া (বর্তমানে বহিষ্কৃত), কুমিল্লায় ছাত্রলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি বিএনপির সাবেক নেতা বর্তমানে যুবলীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক তসলিম উদ্দীন, শিবির ও ছাত্রদলের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা বর্তমানে যুবলীগের আইসিটি সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফিক, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক রাজাকার এনামুল হক চানুর ছেলে বর্তমানে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট কায়সার আহমেদ, ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান বাদল হত্যার আসামি, পরবর্তী সময়ে ছাত্রদল নেতা, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, বর্তমানে যুবলীগের সহসম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন এই সংগঠনের নিয়ন্ত্রক। তাঁরা সবাই কাজী আনিসুর রহমানের লোক। যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ডান হাত বলে পরিচিত কাজী আনিসুর রহমান এসব বহিরাগত, সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজ, ক্যাসিনো পরিচালনার গডফাদারকে নিয়েই যুবলীগে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সংগঠনটির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ত্যাগী নেতাদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ফলে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সব কার্যক্রম, কমিটি গঠন, নীতি নির্ধারণসহ সব কিছুতে বহিরাগতরা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন। কারণ এই সংগঠনের গডফাদার হিসেবে যাঁরা পরিচিত, দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসের বদৌলতে তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এসব নেতার। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশীর্বাদে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। অদম্য ক্ষমতার অধিকারী বনে যাওয়ায় জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অপকর্মে। আয় করতে থাকেন কোটি কোটি টাকা। যুবলীগের কর্মসূচিতে তাঁরাই ঢালেন টাকা। গডফাদার এবং তাঁদের পরিবারের বিদেশ ভ্রমণ ও মনোরঞ্জনের খরচ, দামি গাড়ি উপহার, শক্তি প্রদর্শনে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সহযোগিতাসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়ে আসছে কাজী আনিসের গড়ে তোলা বহিরাগত, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজদের নিয়ে গড়ে তোলা যুবলীগের এই সিন্ডিকেট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হুঁশিয়ারির পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হঠাত্ শুরু করা অভিযানে ক্যাসিনো ও জুয়ার আড্ডা তছনছ এবং সিন্ডিকেটের হোতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় চরম অসন্তুষ্ট যুবলীগের গডফাদাররা। তাঁদের চোখে এখন ঘুম নেই। যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী এরই মধ্যে র‌্যাবের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সমালোচনা করেছেন। তাঁর এই সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পরে চলমান র‌্যাবের অভিযানকে স্বাগত জানালেও চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বক্তব্যে ক্ষুব্ধ যুবলীগে কোণঠাসা কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা। তাঁদের অভিযোগ, বহিরাগত, সন্ত্রাসী, খুনি, টেন্ডারবাজ, সমাজবিরোধীদের রক্ষা করতেই ওমর ফারুক চৌধুরী এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।</p> <p>জানা গেছে, কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও সরাসরি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন ডলার সিরাজ নামে পরিচিত নরসিংদীর সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। তিনি প্রাইভেট একটি ব্যাংকের পরিচালক। বিপুল অর্থের মালিক এই সিরাজ মোল্লা দলীয় মনোনয়ন না পেলেও ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদীর একটি আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন এবং টাকার জোরে নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে। যুবলীগের গডফাদাররা বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সিরাজুল ইসলাম মোল্লাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদটি পাইয়ে দেন বলে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। তেমনি রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদ আল কবির কখনো সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর প্রতিবেশী (ধানমণ্ডিতে একই ভবনে থাকেন) আহমেদ আল কবিরের প্রেসিডিয়াম পদ পাওয়া নিয়ে সংগঠনে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। তার পরও তিনি স্বপদে বহাল আছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিমুলও এখন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। আর এ সব কিছুই হয়েছে নগদ টাকার বিনিময়ে। ২০ লাখ থেকে শুরু করে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত পদ পেতে দেওয়া হয়েছে কাজী আনিস, তাঁর সিন্ডিকেট অথবা যুবলীগের গডফাদারদের। এভাবে প্রায় দুই হাজার সহসম্পাদক করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সহসম্পাদককে কোনো চিঠি নয়, মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে তাঁদের পদ পাওয়ার সংবাদ জানানো হয়েছে। এই সহসম্পাদকরা শুধু ভিজিটিং কার্ড ও পোস্টারে তাঁদের পদবি ব্যবহার করতে পারেন। অবশ্য খুবই কমসংখ্যক ভাগ্যবান যুবলীগের প্যাডে লেখা চিঠিতে পদ পাওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। যুবলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা বলছেন, এসব বহিরাগতই যত অপকর্মের হোতা। তাঁদের কারণে ক্ষুণ্ন হচ্ছে যুবলীগের ভাবমূর্তি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানে তাঁরাই অপরাধী বলে প্রমাণিত হয়েছেন।</p> <p>গণমাধ্যমে এই মুহূর্তে যে নামটি সবচেয়ে আলোচিত সেই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট একসময় মতিঝিল পাড়ায় জুয়ার আসরে রাত কাটাতেন। জানা গেছে, গুলিস্তানকেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপকে জুয়ার বখরা দিতে গিয়ে বিরক্ত সম্রাট তৎকালীন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সঙ্গে দেখা করে সংগঠনে যুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় জানানোর পর সংগঠনের সাবেক ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম সম্পাদকের পদ লাভ করেন। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, নেতাকর্মীরা মামলা-হামলা ও হয়রানির শিকার, তখন সম্রাট কোনো কর্মসূচিতে থাকতেন না। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও তাঁকে কোথাও কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন যুবলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা। অথচ দল ক্ষমতায় এলে তিনি রাতারাতি যুবলীগের বড় নেতা বনে যান। পদ পান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির সভাপতির। তাঁর কারণেই যুবলীগ এখন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁরই সহযোগী ও ডান-বাম হাত হিসেবে যাঁরা পরিচিত তাঁরা সবাই ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি অথবা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পদ বাগিয়ে নিয়েছেন যুবলীগের।</p> <p>গত শনিবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সভা শুরুর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম বলেন, ‘চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ধরা পড়া সবাই একসময় যুবদল, বিএনপি, জামায়াত অথবা শিবির করত। তিনি বলেন, এরই মধ্যে যাদের ধরা হয়েছে তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী। আমাদের দলে দীর্ঘদিন থেকে একটা দাবি উঠেছিল যে এই অনুপ্রবেশকারীরা ভয়ানক ক্ষতি করছে। তাদেরকে এখন আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’</p> <p>প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বহিরাগতদের নিয়ে মন্তব্য করলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদের। গতকাল সোমবার তাঁদের সঙ্গে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তাঁরা ফোন ধরেননি। দুপুরে ধানমণ্ডিতে ওমর ফারুক চৌধুরীর অফিসে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তাঁরা বহিরাগতদের কারণে সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর কাছে যেতে পারেন না। সুবিধাভোগীদের একটি বলয় সব সময় তাঁকে ঘিরে রাখে। এই সুবিধাভোগীদের নামই এখন গণমাধ্যমে আসছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধীর তালিকায় রয়েছেন তাঁরাই।</p> <p> </p>