<p>বাংলাদেশসহ বিশ্বে এখন পর্যন্ত ক্যান্সার শনাক্তকরণে সবচেয়ে প্রচলিত ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে চালু আছে বায়োপসি ও এফএনএসি (ফাইন নিডল অ্যাসপাইরেশন সাইটোলজি); যার একটি করা হয় মানবদেহের সন্দেহজনক অংশের মাংসকোষ কেটে নিয়ে, আরেকটি করা হয় সুঁই দিয়ে নির্যাস নিয়ে। এর বাইরে আরো কোনো কোনো পদ্ধতি নিয়ে অনেক ধরনের গবেষণা পর্যালোচনা চলছে বিভিন্ন দেশে। এমনকি গত বছরই বাংলাদেশের আরেক বিজ্ঞানী সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকসহ একটি দল রক্তের মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি</p> <p>উদ্ভাবন করেন, যদিও সেটি এখনো সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যেই রক্তে বা কোষকলায় এর আগে অজানা ক্ষুদ্র প্রোটিন (পেপটাইড) দেখে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করার উপায় উদ্ভাবন করার দাবি জানালেন বাংলাদেশেরই আরেক দল গবেষক।</p> <p>এই গবেষকদের গবেষণা প্রতিবেদন গত ২৩ আগস্ট ‘হারনেসিং দ্য টিস্যু অ্যান্ড প্লাজমা লিংকআরএনএ-পেপটাইডোম টু ডিসকভার পেপটাইড-বেইসড ক্যান্সার বায়োমার্কারস’ শিরোনামে প্রকাশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক শীর্ষ পর্যায়ের বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টে। এ উদ্ভাবনের পেছনে মূল কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ছয়জন শিক্ষক ও গবেষক। তাঁদের সঙ্গে জার্মানির ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল বায়োইনফরমেটিকস অ্যান্ড সিস্টেম মেডিসিনের দুজন গবেষকও অংশ নেন। তাঁদের উদ্ভাবন পদ্ধতিটি কার্যকর হলে শুধু রক্ত পরীক্ষার জন্য সারা দেশে ব্যবহৃত এলাইজা মেশিন ব্যবহার করেই সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মতো মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচেই একেবারে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব হবে। সময়ও লাগবে অন্য যেকোনো পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেয়ে অনেক কম।</p> <p>বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে এখন অন্য যেকোনো রোগের মধ্যে ক্যান্সারের ভয়েই মানুষ বেশি শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। নিত্যনতুন চিকিৎসাপদ্ধতি কিংবা ক্যান্সার নির্ণয়ক প্রযুক্তির সুবাদে চিকিৎসক বা চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে; রোগীদের ভরসা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এতে যেমন সাফল্য আসছে আবার হতাশারও কমতি নেই। সেই সঙ্গে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে চিকিৎসার খরচ মেটাতে। হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রযুক্তি ও জনবল সংকটের মুখে দীর্ঘসূত্রতার কারণে। সরকারি কিংবা বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই এখন ক্যান্সার চিকিৎসার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোগ নির্ণয় যন্ত্র বা প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। এর সঙ্গে রয়েছে চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ। ফলে ক্যান্সার হাসপাতাল কিংবা ইউনিটগুলোতে মানুষের ভিড় থাকে উপচে পড়া। কেউ কেউ মাসের পর মাস ঘুরতে থাকে সিরিয়াল নিতে। অন্যদিকে ক্যান্সার নির্ণয় প্রতিবেদনের ওপর আস্থা রাখতে পারে না অনেকেই। ফলে মানুষ এক ল্যাবরেটরি থেকে ছোটে আরেক ল্যাবরেটরিতে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন এক আশার আলো ফুটে উঠেছে—দেশের বিদ্যমান প্রযুক্তির মাধ্যমেই এখনকার চেয়ে আরো অধিকতর সহজ উপায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে। রক্ত ও কোষের নমুনা পরীক্ষা শুধু ঢাকায়ই নয়, দেশের অনেক জেলা শহরে বসেই সম্ভব।</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বিভাগের ল্যাবেই প্রায় দুই বছর ধরে গবেষণার মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্তকরণের নতুন এক উপায় উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের সহযোগী অধ্যাপক সজীব চক্রবর্তী ও ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জফ্রি এন্ড্রেইউ এই গবেষণায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। আমরা বাকি সাতজন তাঁকে ঘিরেই প্রয়োজনমতো উপদেশ-পরামর্শ কিংবা সহায়তামূলক কাজ করেছি।’ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মানবসহ সব প্রজাতির বৈশিষ্ট্য জমা থাকে তার নিজস্ব ডিএনএ নামের বিশাল অণুর প্যাঁচানো সিঁড়ির ধাপে ধাপে। ডিএনএ থেকে আরএনএ এবং তা থেকে প্রোটিন জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের এমন প্রবহমানতার মধ্য দিয়ে প্রজাতির নানা বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হতে থাকে। এই প্রবহমানতায় কোনো ত্রুটি হলে ক্যান্সারসহ নানা কঠিন রোগের কবলে পড়ে মানুষসহ সব প্রজাতি।’</p> <p>অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই উদ্ভাবনের বিশিষ্টতা হচ্ছে ক্যান্সার রোগের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় তা নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা। অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থায় তা শনাক্ত করার ব্যবস্থা না থাকায় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। এবার তা সম্ভব হয়েছে।’</p> <p>ড. সজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে আমরা এই গবেষণাকাজ শুরু করি। শেষ হয় চলতি বছরের মার্চ মাসে। এর পরই এই গবেষণার ফলাফল প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হয় নেচারে, যেখানে এই গবেষণা নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারমূলক প্রতিবেদন প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এখন আমরা চাইলেই এ উদ্ভাবনের মেধাস্বত্ব নিতে পারি। তবে সবার আগে আমরা চাই বাকি কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এর সুফল আমাদের দেশের মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে। বিশেষ করে, এই পরীক্ষার কিট তৈরি করব আমরা। কিট তৈরি হয়ে গেলেই দেশে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি দিয়েও যেকোনো হাসপাতাল বা প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মতো করেই ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে; যার জন্য হয়তো ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মতো খরচ হতে পারে। আর এ পরীক্ষার ফলাফল জানতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা।</p> <p>এই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ড. আনোয়ার হোসেন, ড. সজীব চক্রবর্তী ছাড়াও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানিয়া রহমান, সহকারী অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন, প্রাক্তন ছাত্র মোসাদ্দেক আহম্মেদ, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত প্রাক্তন ছাত্র এ এম মাহমুদুল হাসান এবং জার্মানির ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জফ্রি এন্ড্রেইউ ও মেলানিয়া বয়েরিস অংশ নেন।</p> <p>ড. সজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘এই গবেষণাকাজ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে, যেখানে ৯২ জন কোলন ক্যান্সার ও ১১ জন প্রস্টেট ক্যান্সারের রোগী এবং ৩০ জন সুস্থ মানুষের টিস্যু ও রক্তের নমুনা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এটি সাধারণ মানুষের জন্য নিয়ে যাওয়ার আগে আরো কিছু ধাপ পার করতে হবে এবং অনুমোদন নিতে হবে। বিশেষ করে এখন আরেকটু বড় আকারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হবে এবং কিট তৈরির জন্য অন্য কারো সহায়তা নিতে হবে। কারণ আমাদের এই বিভাগের একার পক্ষে সামনে বাকি কাজগুলো করা কঠিন হয়ে পড়বে, যদিও এই কাজের জন্য বেশি দীর্ঘ কোনো সময় লাগবে না।’</p> <p>জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বায়োপসি ও এফএনএসি-ই ক্যান্সার নির্ণয়ের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত আছে। বিভিন্ন সময় আরো কিছু গবেষণার কথা শুনলেও তার কার্যকারিতা নির্ভর করছে এফডিএ (আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটির) অনুমোদনের ওপর। ওই সংস্থা যতক্ষণ এ ধরনের কোনো আবিষ্কারের অনুমোদন না দেয়, তত দিন তা সর্বজনীনভাবে প্রয়োগ করার উপযোগী হিসেবে আমরা মনে করি না।’</p>