<p>‘মনে হয় আধাঘণ্টা পরে টের পেয়েছিলাম। অফিসের দরজা খুলে দেখি বের হওয়ার কোনো স্কোপ নেই। আগুন আর ধোঁয়া। আবার রুমে ঢুকে পড়ি। আমরা ২৭ জন ছিলাম। ধোঁয়ায় সেখানেও দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একপর্যায়ে আমি সাহস করে জানালা দিয়ে বের হই। সহকর্মী মাসুমও আমার পেছনে আসে। ভবনের সামনের এসির অ্যাঙ্গেল বেয়ে বেয়ে ১১টি তালা পাড়ি দিয়ে ছাদে পৌঁছাই। বাঁচার চেষ্টায় কিভাবে পেরেছি জানি না! পরে পাশের ভবনের ছাদে গিয়ে সেখান থেকে নেমে আসি। আমার সহকর্মী যারা ভেতরে ছিল তাদের মধ্যে পাঁচজনই মারা গেছে। ১৩ তলা, ১৪ তলা আর ১৮ তলার সিঁড়িতে তাদের লাশ পাওয়া গেছে। ধোঁয়ায় আটকে শ্বাসকষ্টেই ওরা মারা গেছে। বাকিদের উদ্ধারকর্মীরা বের করে আনতে পারে।’</p> <p>আগুনের ভয়াবহতার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই তদন্তকারীদের জানান বনানীর এফআর টাওয়ারের ১১ তলার এয়ার সার্ভিস বিডি নামের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসিবুর রহমান সবুজ। গতকাল রবিবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির গণশুনানিতে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি।</p> <p>এফআর টাওয়ারের নবম তলার প্রত্যক্ষদর্শী শহিদুল ইসলাম টেকনোলজি গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করেন। তিনি তদন্তকারীদের বলেছেন, ‘মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় আমাদের ফ্লোর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। নিজে ও সহকর্মীদের বাঁচাতে মনে হলো ১০ মিনিটের মধ্যে জানালা ভেঙে বের হতে হবে। তখন কয়েকজন সহকর্মী মিলে রড দিয়ে জানালার কাচ ও গ্রিল ভেঙে ফেলেছি। কিভাবে পেরেছি, জানি না। পরে পাশে আহমেদ টাওয়ারের জানালায় উঠলাম, আমার অন্য সহকর্মীদের বলে রড নিয়ে ওই গ্রিল ও গ্লাসটি ভেঙে সেখান দিয়ে বের হয়েছি। পরে ওই দুই জানালা দিয়ে একে একে ৩৫ জন বের হয়।’</p> <p>সবুজ ও শহিদুলের মতো ২৪ প্রত্যক্ষদর্শী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির কাছে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। এফআর টাওয়ারের বিভিন্ন তলায় কর্মরত এসব প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুয়ায়ী, ভবনটির অষ্টম তলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ওপরের তলাগুলোতে ধোঁয়া ও আগুনের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে। ভবনে অগ্নিনির্বাপণ এবং জরুরি প্রস্থানের ব্যবস্থা যথার্থ না থাকায় অনেকেই আটকে পড়ে। বাজেনি অগ্নিকাণ্ডের বিপত্সংকেত (ফায়ার অ্যালার্ম)। ভবনে কখনো অগ্নিকাণ্ডের মহড়া না হওয়ায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা দরকার, তা-ও জানত না ভবনে থাকা লোকজন। এ কারণেই ২৬ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত ও অসুস্থ হয়েছে বলেও দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের।</p> <p>গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল বনানীর এফআর টাওয়ারের পাশে সাফুরা টাওয়ারে পুলিশের অস্থায়ী বুথে এ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানি শেষে তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, ২৪ জনের মধ্যে ১২ জনই বলেছে অষ্টম তলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত। অষ্টম তলায় স্পেক্ট্রা এসএনটেক্স নামে একটি বায়িং হাউসের অফিস ছিল। শুনানিতে অষ্টম তলার কোনো কর্মী অংশ নেয়নি। তবে শুনানি শেষে ওই প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হয়ে দাবি করেন, অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়নি।</p> <p>এফআর টাওয়ারের দশম তলার আমরা টেকনোলজির মহাব্যবস্থাপক মোস্তফা কামাল চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতায় বলেন, ‘নিচে আগুন লেগেছে টের পাই ধোঁয়া দেখে আর চিৎকার শুনে। বের হয়ে দেখি ধোঁয়ায় সিঁড়ি আচ্ছন্ন। সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করে পারিনি। একপর্যায়ে অফিসের আমরা ৩৫ জন ওয়াশরুমে ঢুকে যাই। আমরা জানালা ভেঙে পাশের আহমেদ টাওয়ারের আরেকটি জানালার গ্রিল ভাঙতে চেষ্টা করেও পারিনি। তখন বাইরে থাকা কলিগদের ফোন করি। ওরা এসে ভাঙে। এভাবে আমরা ৩৫ জনই বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম।’</p> <p>শুনানিতে অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে নবম তলার ইনপায়ার গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার এম এম কামাল বলেন, ‘আমি নিচে ছিলাম। আমাদের অফিসের একজন মারা গেছেন। আমরা নিচ থেকে দাঁড়িয়ে আটতলায় আগুন জ্বলতে দেখেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভবনে কোনো ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি। প্রতিটি তলায়ই ছিল স্মোকিং জোন।’</p> <p>প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, আগুন লাগার পর এফআর টাওয়ারে থাকা অনেকেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করে। কেউ বা ছুটে যায় ওপরের দিকে। তারা নিচে নামার পথ পায়নি। ওপরে থাকা অনেকে নামতে চেয়েও ধোঁয়ার কারণে পারেনি।</p> <p>দশম তলার আমরা টেকনোলজির কর্মী শুভগত কর্মকার বলেন, ‘এখানে কখনোই আগুনের মহড়া হয়নি। এ কারণে আমরা জানি না অগ্নিনির্বাপণের জিনিসগুলো কোথায় এবং সেগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। ধোঁয়া থাকায় আমরা এগুলো খুঁজেও পাইনি।’</p> <p>ভবনটির ১৩ তলার ডার্ড নামের একটি পোশাক কারখানার কর্মী শফিকুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তাকর্মীরা বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিঁড়ি দিয়ে প্রথমে সাততলায় যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন নামার মতো অবস্থা নেই। পরে তিনি ওপরে উঠে যান। ৯, ১০ বা ১১ তলার কর্মীরা এ সুযোগ পায়নি বলে দাবি করেন শফিকুল।</p> <p>এফআর টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী রমজান আলী তদন্ত কমিটিকে বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমি আগুনের খবর পাই। নিচতলা থেকে দ্রুত ভবনের দ্বিতীয় তলার বিভিট অফিসে উঠে যাই এবং সবাইকে বের হয়ে আসতে বলি। আমি যখন ওপরে উঠছিলাম, তখন কোনো ধোঁয়া ছিল না। কিন্তু নিচে নামার সময় প্রচণ্ড ধোঁয়া দেখেছি। এই ধোঁয়ায় সবাই রুমাল মুখে চেপে ধরে সিঁড়ির রেলিং ধরে দ্রুত নিচে নেমে আসে।’</p> <p>সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব ফায়জুর রহমান বলেন, ২৪ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তবে এটা চূড়ান্ত নয়। তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বলেন, ‘ভবনটি সম্পূর্ণ গ্লাস দিয়ে ঢাকা থাকায় আগুনে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা বের হতে না পেরে পুরো ভবনের ফ্লোরগুলো ও সিঁড়িতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ জন্য মানুষের বের হয়ে আসাটা কঠিন ছিল। আমরা সবার বক্তব্য শুনেছি। আর কী কী ব্যবস্থা থাকলে তারা আরো দ্রুত বের হতে পারত, সেগুলো আমরা সুপারিশের মাধ্যমে তুলে ধরব। তিনি বলেন, ‘গণশুনানিতে আমরা অষ্টম তলার স্পেক্ট্রা এসএনটেক্স লিমিটেডের কাউকে পাইনি। তবে এই ফ্লোরে মালিককে আমরা অফিসে ডেকেছি। তিনি কাগজপত্রসহ অফিসে এসে দেখা করবেন।’</p> <p>আলাদাভাবে সাক্ষ্যগ্রহণ করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও। এ শুনানি শেষে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক নিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আটতলায় কোনো লাশ তাঁরা পাননি। লাশগুলো ছিল ওপরের তলার দিকে। ধোঁয়া নিয়মানুযায়ী ওপরে গেছে। শ্বাসরোধে মানুষ মারা গেছে।’</p> <p>শুনানি শেষে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে হাজির হয়ে স্পেক্ট্রা এসএনটেক্সের সহকারী ব্যবস্থাপক কফিল উদ্দিন দাবি করেন, তাঁদের ফ্লোরে আগুন লাগেনি। তাঁরা ওপর থেকে আগুনের ফুলকি পড়তে দেখেছেন। তাঁর দাবি, অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ময়নুদ্দীনকে নিয়ে কাজ করছিলেন। ঢাকার হেড অফিসে কাজ করে ১৭ জন। অন্য ১৫ জন অফিসের কাজে বাইরে ছিল। তাদের কারখানা সম্প্রতি নীলক্ষেত থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত হয়েছে।</p> <p>তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়জুর রহমান বলেন, ‘হয়তো বা মালিকপক্ষের কথা তারা এভাবে দাবি করছে। আজ শুনানি শেষ। আমরা এদের সঙ্গে পরে কথা বলব।’</p> <p> </p> <p> </p>