<p>মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রার্থী যখন নিজ আসনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রতিপক্ষের হামলার অভিযোগ করছেন; একই সময় এর উল্টোচিত্র দেশের সর্বপশ্চিমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত নদী মহানন্দার মতো এখানকার নির্বাচনী পরিবেশও বেশ শান্ত।</p> <p>চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল ওদুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিনা বাধায় প্রচার চালাচ্ছেন বিএনপির প্রার্থী হারুনুর রশীদ। সম্পর্কে দুজন চাচাতো ভাই। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলও আপেল প্রতীক নিয়ে নির্বিঘ্নে প্রচার চালাচ্ছেন। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন খোদ স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল ইসলাম বুলবুল। নতুন-পুরনো কোনো মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগও ওঠেনি। উল্টো অভিযোগ আছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘিরে সংঘটিত নাশকতার মামলার আসামিও প্রকাশ্যে তৎপর।</p> <p>চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার আলমগীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু আছে। একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা কিছু করা দরকার, আমরা তা-ই করছি।’</p> <p>১৯৯১ সালের পর থেকে এই আসনে কখনো বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য কিংবা সমঝোতা হয়নি। এবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম বুলবুল নির্বাচন থেকে সরে না যাওয়ায় উত্তাপ ছড়িয়েছে মাঠে। বুলবুল স্পষ্ট জানিয়েছেন, যত চাপই আসুক, নির্বাচনী মাঠ ছাড়বেন না তিনি। আর বিএনপির প্রার্থী ও দলের যুুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। তিনি বলেন, ‘এ আর নতুন কি! ছিয়ানব্বই সাল থেকে জামায়াত থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখে আসছি।’</p> <p>বিএনপি-জামায়াত বৈরিতায় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ। এর আগে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের ভোট কাটাকাটির মাঝখানে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ওদুদ। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে এবারও ২০০৮ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় অনেক ভোটার।</p> <p>গতকাল সোমবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, চা দোকানদার, তরুণ ভোটার, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষের সঙ্গে। কেউ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা বলেছে। কেউ বলেছে লাগামহীন অনিয়ম, দুর্নীতির লাগাম টানা জরুরি। তরুণ ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা চেয়েছে, যাতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের প্রথম ভোটটি দিতে পারে। তাদের দাবি, চাকরির জন্য যাতে হন্যে হয়ে ঘুরতে না হয়। কৃষকদের দাবি, ক্ষমতায় যে-ই আসুক, জেলায় আম সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ভোটাররা একটি বিষয়ে একমত—নির্বাচন ঘিরে যাতে কোনো নাশকতা ও তাণ্ডব না হয়। </p> <p>মহানন্দার পাশে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যেখানে শাহাদাতবরণ করেছেন, তার কাছে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ছোট চায়ের দোকান। শীতের সকালে সেখানে গিয়ে পাওয়া গেল নির্বাচনী উত্তাপ। সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজনীতিতে এরশাদ এখনো যে তুরুপের তাস তা তিনি উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন পাশের কয়েকজনকে। সদর আসনের ভোটার রিকশাচালক তরিকুল ইসলাম (৫৩) বললেন, ‘আমাদের এলাকায় জামায়াতের বেশ প্রভাব। তারা বুঝতে চায় না উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা দরকার। আমাদের এলাকায় যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। আরো উন্নয়ন দরকার।’</p> <p>নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে কথা হয় উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মিঠুন আলীর সঙ্গে। তাঁর মতে, গত দশ বছরে সদরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আরো উন্নয়ন করতে হলে এই সরকারের ধারাবাহিকতা দরকার। একই কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তরুণ ভোটার রহমত আলী পরবর্তী সরকারের কাছে চাকরির নিশ্চয়তা চাইলেন। আর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বললেন, ‘আমি সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা চাই।’ নবাবগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. সৈয়দ মোহাম্মদ মোজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কলেজে মাত্র ১৪টি বিষয়ে অনার্স আর মাত্র চারটি বিষয়ে মাস্টার্স আছে। অনার্স ও মাস্টার্সের বিষয় বাড়ানো জরুরি। এখনকার তরুণ সমাজ ইতিহাস সচেতন। তাই আমি চাইব, যে সরকারই আসুক, আমার কলেজের উন্নয়নে তারা ব্যবস্থা নেবে। স্কুলের সংখ্যাও বাড়াবে।’</p> <p>আদালত চত্বরের সামনে কথা হয় শাহ নেয়ামত উল্লাহ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর জানান, যত বাধাই আসুক, নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে যাবেন তিনি। তিনি বলেন, পদ্মা নদীর ভাঙন এলাকার প্রধান সমস্যা। যে দলই পরবর্তী সরকার গঠন করুক, নদীভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে ভাঙা রাস্তাঘাট ঠিক করতে হবে।</p> <p>চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ‘শান্তি মোড়’ বেশ জমজমাট থাকে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এখান থেকে শিবগঞ্জ উপজেলায় যাওয়ার রাস্তা। ছয় বছর ধরে শান্তির মোড়ে দোকান চালাচ্ছেন সিরাজুল ইসলাম। তাঁর মতে, সদর আসনে লড়াই হবে ত্রিমুখী। এখানে তিন প্রার্থীরই ভোটব্যাংক আছে। তবে বিএনপি ও জামায়াতের ভোট কাটাকাটি হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সুবিধা হবে বলে অভিমত তাঁর।</p> <p>একাধিক সুধীজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সদর আসনে তিন প্রার্থীর মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। তবে এখনই বলার সময় হয়নি, শেষ হাসি কে হাসবে। কারণ তিন প্রার্থীর রয়েছে দুর্বলতা। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আব্দুল ওদুদের বিরুদ্ধে আছে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে যাঁদের জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁরা নিষ্ক্রিয় থাকলে বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হবে ওদুদের জন্য। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী হারুনুর রশীদের স্ত্রী সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়ার রূঢ় আচরণে জেলা বিএনপির অনেকে ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া জেলায় যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা নির্বাচনে কতটা সক্রিয় থাকবেন তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। এর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর যন্ত্রণা তো আছেই।</p> <p>চাঁপাইনবাবগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি সাইফুল ইসলাম রেজা মনে করেন, লড়াই হবে ত্রিমুখী। শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবেন ভোটের আগে বলা অসম্ভব।</p> <p>আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল ওদুদ বলেন, ‘সদর আসনে সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে। কোনো প্রার্থীর অভিযোগ নেই। জয়-পরাজয় যা-ই হোক মেনে নেব।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ সচেতন। জামায়াত কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না এটা মানুষ জানে। মানুষের আমার প্রতি আস্থা আছে। আমার প্রতিশ্রুতির অধিকাংশ বাস্তবায়ন করেছি।’ দুই মেয়াদে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। অনিয়ম ও দুর্নীতির খাত কোথায়?’</p> <p>বিএনপির প্রার্থী হারুনুর রশীদ বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি শতভাগ নিশ্চিত, এই আসনে ধানের শীষ জয়লাভ করবে।’ জামায়াত থেকে স্বতন্ত্র দাঁড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ভোটে তার প্রভাব পড়বে না।  দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই বলে দাবি তাঁর।</p> <p>স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক আছে। ২০০৮ সালের মতো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবার তা হবে না। কারণ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছি।’</p> <p> </p>