সোমবার । ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯। ১ পোষ ১৪২৬। ১৮ রবিউস সানি
পুলিশের প্রধান ছিলেন তিনি। ছিলেন যুব ও ক্রীড়া সচিব। তিনি নূর মোহাম্মদ। পুলিশের চৌকস এই অফিসার মরক্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অবসরে যাওয়ার পর জনসেবাকে লক্ষ্য হিসেবেই ধরেছেন তিনি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে নৌকার মাঝি হিসেবে মনোনয়ন পেতে চান। তিনি নিজ এলাকার মানুষের কাছেই শুধু নন, সারা দেশে একটি জনপ্রিয় মুখ। সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলছেন, জন্মস্থান আমার শিকড়। একজন প্রকৃত মানুষ শিকড়কে কখনোই ভুলতে পারে না। যে এলাকায় বড় হয়েছি, যেখান থেকে উঠে এসেছি, শেষ সময়টা সেখানকার মানুষের জন্যই ব্যয় করতে চাই। তাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রকৃত কাজ চাই, যেটা পুলিশে থাকার সময় করতে পারিনি। রাজনীতিতে আবির্ভাব, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তিনি তুলে ধরেছেন কালের কণ্ঠ’র কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন।
কালের কণ্ঠ : হঠাৎ কেন রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছেন?
নূর মোহাম্মদ : প্রতিনিয়তই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু রাজনীতিতে প্রবেশে তো কোনো বাধা নেই, যে কেউ চাইলেই পারে। দীর্ঘ সময় চাকরির পর ৫৯ বছরে অবসরে গেলাম। ৩২ বছর সরকারি চাকরি করেছি। চাকরি করার সময় একটাই বিষয় থাকে, জনসেবা। রাজনীতিবিদরাও জনসেবার কথা বলেন। চাকরিতে থেকে যেটা দেখেছি, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেটা দেখেছি, জনসেবা কথাটা মুখেই থাকে। কর্মক্ষেত্রে জনসেবা যতটুকু করা দরকার সেভাবে হয়ে ওঠে না। চাকরির অভিজ্ঞতায় রাজনীতিতে এসে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পেলে অনেকের চেয়ে ভালো (বেটার) পারফর্ম করতে পারব।
দ্বিতীয়ত, আমরা যে রাজনীতি দেখছি, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ জেলার রাজনীতি দেখে মনে হয়েছে, যাঁরা নেতৃবৃন্দ আছেন, এলাকার যাঁরা রাজনীতিবিদ আছেন, রাজনীতিটা যেভাবে করা দরকার, সেভাবে হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারির ঘটনা রয়েছে। পাকুন্দিয়ায় যেটা আমি শুনি, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা শত শত মামলায় এবং হাজার হাজার আসামি। তাঁরা জেল খাটছেন। এটা রাজনৈতিক কোন্দলের জন্য, নেতৃত্ব না থাকার জন্যই হচ্ছে। এগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে, আমি এখানে ভালো কাজ করতে পারব।
রাজনীতিবিদরা হলেন জনগণের আস্থা, ভরসা আর বিশ্বাসের প্রতীক। জনগণ রাজনীতিবিদদের ভোটটা কিন্তু এই আশা নিয়েই দেয়। জনপ্রতিনিধি আমাদের কষ্টে, দুঃখে থাকবেন, এগিয়ে আসবেন। আমি চাকরিতে থাকার সময় চেষ্টা করেছি, সেবা বলতে যেটা বোঝায়, আমার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, যদি আমি জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পাই, তবে আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করব।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশে চাকরি করলে মানুষের উপকার করার সুযোগ থাকে ও অনেক বেশি ক্ষমতা থাকে। পুলিশের চাকরি ও রাজনীতিতে যাওয়া এবং মানুষের সেবা করার বিষয়টি অর্থাৎ দুই মাধ্যমের তুলনাটা যদি করতেন।
নূর মোহাম্মদ : পুলিশকে আমরা এটাই বলি, পুলিশ সমাজে যে পরিমাণ ভালো করতে পারে এ পরিমাণ খারাপও করতে পারে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর। যেমন ধরেন পুলিশে অনেকে খুব ভালো কাজ করেন। অনেক সুনামের সঙ্গে কাজ করেন। আবার অনেক সময় বিভিন্ন রিপোর্টে দেখি অনেকে খারাপ কাজ করছে। এটা কিন্তু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের বিষয় আছে। পুলিশে কাজের জায়গা খুব সংকীর্ণ। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েই কাজ করতে হয়। আর জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজের পরিধি অনেক বৃহৎ (ওয়াইড)। অনেক বিস্তৃত্ব। জনপ্রতিনিধি হলে আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি সব কিছু নিয়ে কাজ করতে পারব। পুলিশ কিংবা সচিবালয়ে যখন সেক্রেটারি হিসেবে বা রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলাম, তার চেয়ে রাজনীতিতে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি। আরেকটা বিষয় হলো শিকড়। আমি একজন মানুষ, প্রকৃত মানুষ তিনি যিনি শিকড়টা ভুলতে পারেন না। আমার মনে হয়েছে, যে এলাকা থেকে উঠে এসেছি, যে এলাকায় বেড়ে উঠেছি, শেষ সময়টা ওদের জন্য ব্যয় করতে চাই।
কালের কণ্ঠ : আপনার লক্ষ্যটা কী, কী করতে চান, যেটা করলে আপনার যে অপূর্ণতা সেটা পূর্ণতা পাবে?
নূর মোহাম্মদ : মানুষের জীবন একটা। এটাকে কিভাবে কাজে লাগাবেন সে পছন্দও কিন্তু আপনার। আমি মনে করি, এলাকায় আমার বড় কাজটা হলো সেবা। আমাদের এলাকায় দুটি উপজেলা নিয়ে কনস্টিটিউয়েন্সি। এখানকার যত মানুষের সঙ্গে মিশেছি, আমার মনে হলো ওইটা একটা স্কুল। ছোটবেলায় বাবা-মা, ভাই-বোনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি; স্কুলে গেলাম, কলেজে গেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, তারপর চাকরি। আরেকটা বিষয় হলো মানুষের সঙ্গে মেশা, যেটা আমরা বলি স্কুল অব লাইফ। জীবনের স্কুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। আমি এলাকায় যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, যত ঘুরছি, নতুন করে অনেক কিছু শিখছি। এটা একটা স্কুলের মতো মনে হয়। এখানে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে উন্নয়নের যে বিষয়টা বলি, উন্নয়নটা বহুমাত্রিক, বহুমুখী। আজকাল মাদকের বিষয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। ওইখানে দেখি যুবসমাজ, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগই যুবসমাজ, যাদেরকে আমাদের ভবিষ্যৎ বলি। তারা যাতে ভবিষ্যতে ঠিকমতো কাজ করতে পারে সে রাস্তা দেখাতে পারি, তারা যেন ভালো উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে, ভালো চাকরিতে যেতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে। আমি এলাকার সবাইকে নিয়ে বসব, বিভিন্ন সেক্টরে তাদের কাছ থেকে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করব; কোন কোন এলাকায় কী সমস্যা রয়েছে। সব এলাকার সমস্যা এক রকম না। কোথাও রাস্তাঘাটের সমস্যা, কোথাও স্কুল-কলেজের সমস্যা। যেমন, আমাদের দুই থানার মধ্যে কটিয়াদিতে পাকুন্দিয়ার চেয়ে শিক্ষার হার অর্ধেক। পাকুন্দিয়ার অর্ধেক হলো কটিয়াদি। মানুষ তো সব সময় তুলনা করে কটিয়াদিকে পাকুন্দিয়ার সমান নিতে হবে। এ রকম অবকাঠামোগত যেসব বিষয় আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ম্যানেজমেন্ট কমিটি হচ্ছে—এগুলো কিন্তু যথাযথ মানুষকে দিতে পারছি না। কিভাবে স্কুলটা চলবে, ম্যানেজমেন্ট কী হবে এ কাজগুলো হচ্ছে না। আমি ওইখানেও কাজ করতে চাই।
মাদক নিয়ে কাজ করতে চাই, নারীর প্রতি সহিংসতা এগুলো নিয়ে কাজ করব, সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করব, সব কিছু নিয়েই কাজ করব, যেন এলাকার সার্বিক উন্নয়ন হয়। গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ কিন্তু অনেক এগিয়ে গেছে। ২০২১ সালে উন্নত দেশের পর্যায়ে যাওয়ার একটা বিষয় আছে। এগুলো নিয়ে সবাই মিলে কাজ করলে, তাহলে যেটা আমরা সবাই প্রায়ই বলি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সেটা কথায় বা স্লোগান না হয়ে বাস্তবে করা সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ : ছাত্ররাজনীতি করেছেন, বয়সের শেষ প্রান্তে আবার রাজনীতিতে এসে কেমন অনুভূতি হচ্ছে?
নূর মোহাম্মদ : একটা অনুভূতি হচ্ছে, আমি যদি এখানে না আসতাম তবে জীবনের অপূর্ণতা থাকত। অপূর্ণতা কেন? রাজনীতিবিদরা যে প্রক্রিয়ায় রাজনীতি করে সেই প্রক্রিয়ায় আমি আসিনি, চাকরি থেকে অবসর নিলাম, দেখলাম আমার অবসরের সঙ্গে ইলেকশনের সময়টা মিলে যাচ্ছে। এই যে তিন বছর মিলে যাচ্ছে, অবসর নেওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় আমি যাচ্ছি। বিগত দুই বছর। যখন যেখানে যাচ্ছি সেখানেই মানুষের ভালোবাসা, ভালো কিছু করতে তাদের আগ্রহ, প্রচেষ্টা ও আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাচ্ছি। তারা ভালো কর্মঠ মানুষ চায়, যাদের ওপর তারা ভরসা করতে পারে। এখানে না এলে এটা বুঝতে পারতাম না।
কালের কণ্ঠ : আপনি নির্বাচিত হলে, দল ক্ষমতায় এলে আপনার যে অভিজ্ঞতা তা বৃহত্তর ক্ষেত্রে ব্যবহারের কী চিন্তা করছেন?
নূর মোহাম্মদ : প্রত্যেকেরই একটা চিন্তা থাকে। আমরা তো প্রথমে ব্যক্তি, পরিবার, দল; রাষ্ট্রীয়ভাবেও মানুষ চিন্তাভাবনা করে। ছোট ছোট কাজ থেকে মানুষ যখন একটু আস্থা পায়, ভরসা পায়, তখন নিজের ওপর বিশ্বাস জন্মে। তখনই কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। বড় পরিসরে করার সুযোগ আসে। চিন্তাভাবনাও আসে। যখন চাকরিতে আসলাম ছোট কর্মকর্তা ছিলাম, আস্তে আস্তে দায়িত্বের পরিসর বেড়েছে। রাজনীতিতে এসে আপাতত শুধু এলাকার বিষয়টা চিন্তার মধ্যে রাখতে চাই। যেহেতু এলাকার মানুষ আমার ওপর আস্থা স্থাপন করেছে, যদি সুযোগ পাই তাদের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করব, যেন তাদের জীবনমান উন্নয়ন করা যায়।
কালের কণ্ঠ : মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?
নূর মোহাম্মদ : ওই যে একটা কথা আছে, আগে একটা স্বপ্ন, তার পরই যাত্রা (জার্নি)। একটা আশা কিংবা প্রত্যাশা। তারপর একটা স্বপ্ন, তারপর জার্নি। শুরু করার অবস্থানে আছি। আমি আশাবাদী। মনোনয়ন না পাওয়ার কোনো কারণ দেখাছি না। আমি শতভাগ আশাবাদী।
কালের কণ্ঠ : বর্ণাঢ্য চাকরিজীবনে ভালো লাগা বা খারাপ লাগার কোনো স্মৃতি বলবেন কি?
নূর মোহাম্মদ : বলার মতো কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু তা শেয়ার না করাই ভালো। অনেক ভালো মানুষ দেখেছি। অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে মিশেছি। দেখেছি এমন কিছু, যা অনেকেই দেখেননি। অভিজ্ঞতার ঝুলি বড় হয়েছে। মানুষের অসহায়ত্ব ও কষ্ট, যারা পুলিশে কাজ করে তাদের চেয়ে বেশি কেউ দেখে না। সবচেয়ে ক্ষমতাবানদের দুঃসহ অবস্থান, অসহায়ত্ব বেশি দেখেছি। ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। একটা কথা সব সময় বলি, সমাজ কিংবা দেশকে যেটা দেবেন, সেটাই ফিরে পাবেন। ভালোটা দিলে ভালো পাবেন আর মন্দটা দিলে মন্দটা পাবেন।
মন্তব্য