<p>গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, এরপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র পিএইচএ ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। মামলার বাদীরাই বলছেন, তাঁরা মূলত সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন।</p> <p>গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১৫ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত আশুলিয়া থানায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জমি দখল, দখলের চেষ্টা, ভাঙচুর, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি ও চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার বাদীরা হলেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার খামারহাটি গ্রামের মোহাম্মদ আলী, আশুলিয়ার ডেণ্ডাবর এলাকার বাসিন্দা হাসান ইমাম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাজধানী ঢাকার আদাবর থানা এলাকার মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির সৈয়দ সেলিম আহমেদ, আশুলিয়ার নলাম এলাকার মো. নাছির উদ্দিন ও রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা ও দ্য কটন টেক্সটাইল ক্রাফটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান কাজী মহিবুর রব। এসব মামলায় ডা. জাফরুল্লাহ ছাড়াও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে।</p> <p>এ ছাড়া গত ২৩ অক্টোবর নানা অনিয়মের দায়ে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালকে ১০ লাখ এবং ফার্মাসিউটিক্যালসকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করে অ্যান্টিবায়োটিক ইউনিট সিলগালা করে দেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।</p> <p>উল্লেখ্য, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ৯ অক্টোবর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে আলোচনার একপর্যায়ে সেনাবাহিনী প্রধানকে নিয়ে কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ করে গত ১১ অক্টোবর সেনা সদরের পক্ষ থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। জিডিটি গত ১৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে এটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হিসেবে গ্রহণ করে তদন্তের জন্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) পাঠানো হয়। এর পরই ডা. জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে শুরু করে।</p> <p>সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা ১৩ শতাংশ জমি নিজের বলে দাবি করে গত ২৩ অক্টোবর আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। সেই সঙ্গে ওই জমি নিজের দখলে নেওয়ার জন্য গণস্বাস্থ্যের পিএইচএ ভবনে যাওয়ার প্রধান ফটক ভাঙচুর করে গত মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করেন। এরপর পুলিশ গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়।</p> <p>নাছির দাবি করেন, ২০০৮ সালে তিনি ১৬ শতাংশ জমি কিনেছেন, যার ১৩ শতাংশ জমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জবরদখল করে আছে। কিন্তু বিগত ১০ বছরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁর লিখিত কোনো অভিযোগ ছিল না। এ বিষয়ে নাছির বলেন, এত দিন জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো অবস্থা তাঁদের ছিল না। তাই তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই তিনি বেহাত হয়ে যাওয়া নিজ জমির অংশ দখলে নিয়েছেন।</p> <p>গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ২৬ অক্টোবর দুর্বৃত্তরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, মারধরসহ শিক্ষার্থী ও নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের লাঞ্ছিত করে। ঘটনার পাঁচ দিন পার হয়ে গেলেও পুলিশ তাঁদের মামলা নথিভুক্ত করেনি। তাঁরা এখন আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, দেশের এবং দেশের বাইরের মানুষ গণস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।</p> <p>আব্দুস সালাস আরো জানান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ১৯৮৭ সালের আগে প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে জমি কিনে ভোগদখল করে আসছে। ওই জমিতে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বের ১০৫টি দেশের ১৫ শতাধিক অংশগ্রহণকারীর সমন্বয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সম্মেলন (পিএইচএ) করে। সেই থেকে ভবনটি পিএইচএ ভবন হিসেবে পরিচিত।</p> <p>গণবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. লায়লা পারভীন বানু কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৫ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ ভবনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনটির আয়োজক পাবলিক হেলথ মুভমেন্ট (পিএইচএম) বাংলাদেশ ও পিএইচএম গ্লোবাল। এ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য বিদেশি প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে নিবন্ধন করেছেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইতিমধ্যে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব।</p> <p>গণবিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মীর মুর্ত্তজা আলী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা জমিতে দুর্বৃত্তরা কয়েক দফা হামলা চালিয়ে এখন স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে। এ জন্য প্রাকৃতিক হ্রদ ভরাট এবং কয়েক শ গাছ কেটে ফেলেছে তারা। যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে সেগুলো বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য অধিকার কর্মী ও দেশের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের লাগানো।</p> <p>গতকাল বুধবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে কাউকে কোনো নির্মাণকাজ করতে দেখা যায়নি। গত ২৬ অক্টোবর হামলার আগের দিন বিকেল থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা জমিতে প্রাচীর নির্মাণকাজ শুরু করেন নাছির উদ্দিন। একই সময় আমিনুল ইসলাম নামের আরেকজন পাশেই দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কাছাকাছি অন্য একটি জায়গায় নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ আলী নামে আরো এক ব্যক্তি। পিএইচএ ভবনের দিকে যাওয়ার প্রধান ফটক এখন আর নেই। ফটকের পাশে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের ভবনটিও আংশিক ভাঙা। নেই ভবনটির দিকে যাওয়ার রাস্তাটির শুরুর দিকের ইটের সোলিং।</p> <p>গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় কেন্দ্রের পক্ষে দুটি, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেডের পক্ষ থেকে একটি এবং আহত লিমন হোসেন একটি অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু পুলিশ গতকাল পর্যন্ত মামলা নেয়নি।</p> <p>এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানার ওসি রিজাউল হক দীপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাঁচ-ছয়জন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামে মামলা করেছে। মামলায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা বিভিন্ন স্থানে মামলাকারীদের জমির অংশ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মঙ্গলবার থেকে সেখানে সব নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শেখ মো. আলমগীর কালের কণ্ঠকে জানান, মঙ্গলবার বিকেলে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অভিযান) মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এলাকা পরিদর্শন করেন। তাঁরা ছাত্রীদের হোস্টেলও পরিদর্শন করেন।</p> <p>আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জাবেদ মাসুদ বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এলাকায় কেউ যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে সে ব্যাপারে সকলকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আর জমিসংক্রান্ত কোনো বিরোধ থাকলে আদালতে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। </p> <p>মামলার বাদীদের সংবাদ সম্মেলন : গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আশুলিয়া প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন মামলার বাদীরা। সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা নাছির ছাড়াও ছিলেন দি কটন টেক্সটাইল ক্রাফটস লিমিটেডের পক্ষে এর পরিচালক শাকিরুল কবির, আমিনুল ইসলামের পক্ষে তাঁর আইনজীবী আমীর হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, আমজাদ হোসেন প্রমুখ। তাঁরা সবাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁদের জমি দখলের অভিযোগ করেন।</p> <p>আদালতে না গিয়ে নিজেরাই কেন লোকজন নিয়ে ভাঙচুর করে দখলের চেষ্টা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নাছির উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও গণস্বাস্থ্যের লোকজনের কাছে জিম্মি ছিলেন।</p> <p>আশুলিয়ায় মানববন্ধন : জমি জবরদখলের অভিযোগ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ও সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে মানববন্ধন করেছেন মামলার বাদীর পরিবার ও এলাকাবাসী। গতকাল সকালে আশুলিয়ার বাইশমাইল-নলাম শাখা সড়কের ঘোড়াপীর মাজার এলাকায় এ মানববন্ধন করা হয়।</p> <p> </p> <p> </p>