<p>২০১০ সালের ধসের ক্ষত শুকিয়ে ফের পুঁজিবাজারমুখী হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের ছোট-বড় বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণে পুঁজিবাজার এখন চাঙ্গা। নতুন করে অর্থ লগ্নি করে শেয়ারবাজারে হারানো পুঁজি ফিরে পেতে অনেকেই তত্পর। ফের মার্জিন ঋণ দিয়ে পুরনো বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। নতুন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও আসছে পুঁজিবাজারে। ইতিমধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক সাড়ে পাঁচ হাজার পয়েন্ট এবং লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে বছরের প্রথম দিন থেকে একটানা সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধিতে অনেকের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধসের সময়ও লেনদেন ও সূচক ক্রমাগতভাবেই বাড়ছিল। এবার বাজারে চলমান উত্থানের সুুবাদে পুরনো কারসাজি চক্র ফের সক্রিয় হচ্ছে বলে মনে করছে কেউ কেউ। এ অবস্থায় বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি নতুন শেয়ারের জোগানে বাড়ানো ও বিনিয়োগকারীদের সচেতন করার পরামর্শ দিয়েছেন পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন, ইপিএস ও অন্যান্য তথ্য বিবেচনা করে ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে তাঁরা বলেছেন, যারা না বুঝে মুনাফার লোভে সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে পুঁজিবাজারে ঝুঁকছে তাদের জন্য পুঁজিবাজার ভালো কিছু বয়ে আনবে না।</p> <p>পুঁজিবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ক্রমাগতভাবে বাজারের উত্থানে ডিএসইর মূল্যসূচক গত ছয় বছরের মধ্যে শীর্ষে উঠে সাড়ে পাঁচ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করেছে। এ বছরের প্রথম ১৫ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় সাড়ে চার শ পয়েন্ট বেড়েছে। বছরের প্রথম ১২ দিনে বাজার মূলধন বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। গত মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেন হয় দুই হাজার ৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা গত ছয় বছরে মধ্যে সর্বোচ্চ। মঙ্গলবার ডিএসইএক্স সূচক প্রায় ৯৮ পয়েন্ট বেড়ে পাঁচ হাজার ৫৭৫  পয়েন্টে ওঠে। একই দিন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৮৭ পয়েন্ট বেড়ে ১৭ হাজার ১৫৯ পয়েন্ট হয়েছে। সিএসইতে সেদিন লেনদেন হয়েছে ১১৪ কোটি ৮১ লাখ টাকার শেয়ার। সর্বশেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার ডিএসইএক্স শূন্য দশমিক ৫৬ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করে পাঁচ হাজার ৫৩৪ পয়েন্টে, লেনদেন হয় এক হাজার ৪০৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার শেয়ার। আর সিএসই সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৯ দশমিক ১৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২ পয়েন্টে। গত এক সপ্তাহে ডিএসইএক্স বা প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে ১৯১ দশমিক ১৯ পয়েন্ট। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে ২৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ  লেনদেন বেড়েছে। </p> <p>তবে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, সূচক ও লেনদেন দীর্ঘ সময় নিম্নমুখী থাকায় শেয়ারের দর একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আর বর্তমানে শেয়ারের দর এখন যেখানে অবস্থান করছে তাও অবমূল্যায়িত। পুঁজিবাজারের নির্দেশক হিসাব করে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিএসইর মূল্য আয় অনুপাত (পিই) আগের বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে ৬.৫৮ শতাংশ কমেছে। ২০১৬ সালে পিই দাঁড়িয়েছে ১৪.২৯ পয়েন্টে। এ হিসাবে পিই কমেছে ০.৯৪ পয়েন্ট বা ৬.৫৮ শতাংশ। খাতওয়ারি পিই পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতের পিই ৮.১৪ ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের পিই ৯.৫৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে, যা সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে বলে ডিএসই কর্তৃপক্ষের দাবি। এ ছাড়া সামগ্রিক বাজারের ১৪.২৯ পিই-কে খুবই কম বলে মনে করা হচ্ছে। তাই শেয়ারবাজারের সূচক ও লেনদেন নিয়ে ভয়ের কিছু নেই বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন ডিএসইর কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে সূচক যে পর্যায়ে গেছে, সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা যাবে না। সূচক নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। বাজারের লেনদেন যেখানে পৌঁছেছে, তা সামলানোর দক্ষতা ও সক্ষমতা দুটিই রয়েছে ডিএসইর। তবে ধারদেনা করে, জমি কিংবা বউয়ের গয়না বিক্রি করে বাজারে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।</p> <p>ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক ও সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বারবার বলার চেষ্টা করছি বাজার কোনোভাবেই অতিমূল্যায়িত নয়। আমাদের পিই রেশিও অনেক কম। কাজেই বাজার এখনো ঝুঁকিপূূর্ণ নয়। গত পাঁচ বছরে দেশের অর্থনীতিতে যে বিপ্লব ঘটেছে তার প্রতিফলন পড়েছে শেয়ারবাজারে। সরকার, বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ডিএসইসহ সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত উদ্যোগে শেয়ারবাজার এখন গতিশীল। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও গত বছর থেকে বিনিয়োগ শুরু করেছে, এতে লেনদেন হঠাৎ করে কিছুটা বেড়ে গেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ছিল। ব্যাংকগুলো তাদের নির্ধারিত মাত্রার অনেক বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপে ব্যাপক দরপতন হয়েছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকের বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমার মধ্যে আছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজার উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করছে।’</p> <p>বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়ে রকিবুর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজারে সব সময় শেয়ারের দাম বাড়বে, এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। যখন শেয়ারের দাম বাড়ে তখন সবাই খুশি থাকে, আর যেই দাম কমে যায় তখন সবাই নাখোশ হবে, এটা অত্যন্ত খারাপ চর্চা। শেয়ারবাজারে মূল্য সংশোধন হবে, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু তা যেসব বিনিয়োগকারী মেনে নিতে পারে না তাদের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে আসার দরকার নেই। কম্পানির মৌল ভিত্তি, পিই রেশিও, আর্থিক প্রতিবেদন, পরিচালক, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি দেখে বিনিয়োগ করতে হবে।’</p> <p>১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজার ধসের পর ২০১০ সালে আবারও বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়েছিল অনেকে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে নির্জন থাকা ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে এখন বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি বাড়ছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সদ্য বিদায়ী পরিচালক ও আইল্যান্ড সিকিউরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘পুরনো বিনিয়োগকারীরা আবার শেয়ারাবাজারে ফিরেছে এবং তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। তাদের কেউ কেউ ২০১০ সালের ক্ষতি আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যারা বাজারের বাবল দেখে বিনিয়োগ করছে তাদের জন্য বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ। ভালো শেয়ারের চেয়ে খারাপ শেয়ারের আনুপাতিক দাম অনেক বেশি বাড়ছে, যার কোনো যুক্তি নেই। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যাদের নাম এসেছে তারা কোনো না কোনো পদবি নিয়ে এখনো সক্রিয়।’</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন দেখছি, সেটা মার্কেটের স্বাভাবিক অবস্থা নয়। এখন বাজারে যে হারে তারল্যপ্রবাহ বাড়ছে, তা স্বাভাবিক। গুজবে কান না দিয়ে কম্পানির বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে।’</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় এবং বিনিয়োগ কম হওয়ায় অনেকে শেয়ারবাজারে টাকা খাটাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মন্দা অবস্থার কারণে অনেক শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় চলে এসেছিল। ফলে এখন দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি লগ্নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।</p> <p>ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় এবং বিনিয়োগ কম হওয়ায় অনেকে শেয়ারবাজারে টাকা লগ্নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে জানালেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মো. সায়েদুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে এফডিআরের সুদের হার ৪ থেকে ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশ। এটা ম্যানেজ করার জন্য অনেকে পুঁজিবাজারকে বেছে নিচ্ছে। কারণ এখানে ১০ শতাংশের ওপর লভ্যাংশ পাওয়া যায়। মুনাফাও করা যায়। বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি এখন শেয়ারবাজারে পড়েছে। জুলাই থেকে শেয়ারবাজার ধীরে হলেও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। আমরা ছয় বছর পতনের বাজারে ছিলাম। এখন উত্থানের দিকে যাচ্ছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে, যার সুফল আগামীতে পাওয়া যাবে। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আগামীতে ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ আরো বাড়বে। প্রভাবিত হয়ে নয়, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বুঝেশুনে বিনিয়োগ করতে হবে।’ </p> <p>তবে শেয়ারবাজারে চলমান উত্থানের মধ্যে কারসাজিও থেমে নেই। ২০১৬ সালে নানা অপরাধে ৩১ কম্পানিকে দুই কোটি ৬৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ার নিয়ে অনবরত কারসাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইউনাইটেড এয়ার ও সিভিও পেট্রোকেমিক্যালের মতো কম্পানি বন্ধ থাকার পরও শেয়ারের দাম বাড়ছে। গত তিন মাসে ৫২টি কম্পানির শেয়ারের দর অস্বাভাবিক বেড়েছে এবং এই দর বাড়ার পেছনে কোনো কারণ নেই বলে ডিএসইর তদন্তে উঠে এসেছে। অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারের দর বৃদ্ধি পাওয়া ৫২ কম্পানির মধ্যে ১৮টিই ‘জেড’ ক্যাটাগরির। আট কম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি নিয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ একাধিকবার তথ্য প্রকাশ করেছে। বিএসইসি সাত কম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে তদন্তে নেমেছে। এসব কম্পানির কোনো কোনোটির বিরুদ্ধে ২০১০ সালেও একই রকম অভিযোগ ছিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক দিন যাবৎ শেয়ারবাজারের সূচক অনেক নিচে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সূচক অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে যারা এখানে ব্যবসা করে তাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেসব শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে তা থেকে দূরে থাকতে হবে।’</p> <p>কারসাজি প্রসঙ্গে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘কারসাজিকারীরা ২০১০ সালে বিভিন্ন অপকর্ম করেও পার পেয়ে গেছে। কাজেই এখন তারা অভিজ্ঞতার সঙ্গে খেলতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিএসইসির সার্ভিল্যান্স বাড়াতে হবে এবং খেলোয়াড়দের ওপর নজর রাখতে হবে।’</p> <p>জেড ক্যাটাগরির শেয়ারে কারসাজি প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘জেড গ্রুপের বেশির ভাগ শেয়ারের ইপিএস নেতিবাচক। যেহেতু এসব শেয়ারের মূলধন কম তাই অনেকেই সহজে এসব কম্পানি নিয়ে খেলাধুলা করতে পারে। বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এসব শেয়ারকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সার্বক্ষণিক সার্ভিল্যান্স ও আইনকানুনের মধ্য দিয়ে এসব শেয়ারে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এদের সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডিএসই ও বিএসইসিকে শক্ত অবস্থানে থেকে লেনদেন স্থগিত, বন্ধ করা, ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে পাঠানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘অবিলম্বে আমাদের স্মল ক্যাপ ও এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) এক্সচেঞ্জ চালু করতে হবে। তাহলে এসব কম্পানিকে আরো নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা সহজ হবে।’  </p> <p>১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার কারণে হয়েছে উল্লেখ করে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির তুলনায় সাড়ে পাঁচ হাজার সূচক খুব বেশি নয়। তবে যেসব কম্পানির কোনো অস্তিত্ব নেই সেসব কম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে, এটা উদ্বেগের বিষয়। একটা উড়োজাহাজ কম্পানি, পেপার কম্পানি হয়ে গেছে, তবু প্রতিদিন তার শেয়ারের দাম বাড়ছে। জুয়াড়িরা কম দামি শেয়ার কিনে বেশি গেইন করে, যেটা ভালো শেয়ারে তারা করতে পারে না। শঙ্কার বিষয় হলো তারা কারো না কারো হাতে শেয়ারটা ধরিয়ে দিচ্ছে। যাদের হাতে পরে গিয়ে শেয়ারটা পড়ছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ারে তাত্ক্ষণিকভাবে মুনাফা কম হলেও বছর শেষে ভালো লভ্যাংশসহ দীর্ঘমেয়াদে তা খুবই লাভজনক।’</p> <p>অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘কেলেঙ্কারি ঘটায় যাদের হাতে লাখ লাখ শেয়ার আছে সেই সব উদ্যোক্তা, পরিচালক। এরা যদি উচ্চ মূল্যে লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির সুযোগ পায় তাহলে তারাই বাজারের বেশির ভাগ টাকা তুলে নিয়ে যাবে। এবার অসৎ পরিচালকরা সূচক বাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শুরুর দিকেই কারসাজি করতে পারে বলে আমার আশঙ্কা। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা হারানো পুঁজি উদ্ধার করতে গিয়ে আবার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাদের হাতে ৫০ শতাংশের নিচে শেয়ার আছে তাদের বিক্রির ওপর বিএসইসির নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিবেদনের অসংগতিকে শাস্তির আওতায় আনতে দ্রুত ফিন্যানশিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল গঠন করতে হবে।’</p> <p>পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরবরাহের উন্নয়নের ওপর। এখানে যেমন আর্থিক তারল্যের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ভালো শেয়ারের সরবরাহ নিশ্চিত করা। শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য আনতে যথেষ্ট নয়। তাই বাজারের অতিরিক্ত চাহিদার কথা মাথায় রেখে বহুজাতিক কম্পানিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানিগুলোর শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন। পুঁজিবাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ার আগেই শেয়ারের জোগান বাড়াতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘মার্জার-অ্যাকুইজিশনেও কারসাজি হচ্ছে। একটা সাবান কম্পানি একীভূত হয়েছে কটন কম্পানির সঙ্গে। এভাবে কিছু কম্পানি একীভূত হচ্ছে বাজারে আসার উপযুক্ত না হওয়ার কারণে। এ ক্ষেত্রে শেয়ার বিক্রিতে চার-পাঁচ বছর নিষেধাজ্ঞা রাখতে হবে। শুধু সভা-সেমিনারে বহুজাতিক কম্পানি তালিকাভুক্ত করার আওয়াজ না দিয়ে তাদের সঙ্গে বসতে হবে, চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কেন ভালো কম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে চায় না তা জেনে তাদের পুঁজিবাজারে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।’</p> <p>বিএসইসির পক্ষ থেকে ১১ ধরনের কারসাজি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করা হয়। কারসাজিগুলো হলো : লেনদেন একাগ্রতা, বিজ্ঞপ্তি সতর্কতা, সুবিধাভোগী প্রকৃত গ্রাহক, সর্বশেষ অবস্থান সূচক, সর্বশেষ মূল্য কারসাজি ও আদেশের বিস্তার, স্বয়ংক্রিয় গ্রাহক, শেয়ার না থাকার পরও বিক্রি (শর্ট সেল), সামনে চলমান গ্রাহক (ফ্রন্ট রানিং ক্লায়েন্ট), চক্রাকার লেনদেন, প্রতারণা ইত্যাদি। চক্রাকার লেনদেন কারসাজির আওতায় দাম বাড়াতে পরিকল্পিতভাবে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে কৃত্রিম লেনদেনের মাধ্যমে দাম প্রভাবিত করা হয়। পর পর তিন কার্যদিবস নির্দিষ্ট শেয়ারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচা করা হয় লেনদেন একাগ্রতার আওতায়। বিজ্ঞপ্তি সতর্কতার আওতায় কোনো কম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগে বা কাছাকাছি সময়ে ওই কম্পানির শেয়ারের লেনদেন ও মূল্যকে প্রভাবিত করা হয়। কোনো কম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহক ও ব্রোকারের লেনদেনের অবস্থান পরিবর্তন করা হয় সুবিধাভোগী গ্রাহক কারসাজির আওতায়। এ ছাড়া কোনো কম্পানির শেয়ারের দাম দিনের সর্বশেষ লেনদেনের ১০ মিনিট আগে নির্দিষ্ট হারে হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটানো হয়। আর কোনো শেয়ারের ক্রয় বা বিক্রয় আদেশের মূল্য ওই শেয়ারের পূর্ববর্তী ক্রয় বা বিক্রয় আদেশের চেয়ে নির্দিষ্ট হারে কম বা বেশি করা হয় আদেশের বিস্তার কারসাজির আওতায়।</p> <p>তবে নানা সংস্কারের ফলে শেয়ারবাজারে এখন অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে বলে জানালেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও পুঁজিবাজারে সেই ধারা বজায় ছিল না। বিএসইসি সেই ধারা তৈরিতে অনেক সংস্কারমূলক কাজ করেছে। বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব সংস্কার ও প্রচেষ্টার ফলে বাজারে সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাজারে গবেষণাভিত্তিক বিনিয়োগ হওয়া উচিত। এতে ভালো মুনাফা পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ফান্ড ম্যানেজমেন্ট একটা বড় ইস্যু। কারসাজি রোধে বিএসইসি সার্ভিল্যান্স টিম কাজ করছে। কোনো অভিযোগ পেলে জরিমানাসহ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে পুঁজিবাজার ট্রাইব্যুনাল শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলার কয়েকটির রায় দিয়েছেন।’</p>