<p>গত মাসের ২৬ তারিখ মারা যান আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা এবং ঢাকার শেষ সরদার আক্তার সরদার। আওয়ামী লীগের বিপদে বহুবার এগিয়ে এসেছেন তিনি। অথচ এ মানুষটির মৃত্যুতে দলীয় কোনো নেতা শ্রদ্ধা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। এতে সরদারের স্বজনরা মর্মাহত ছিল। তবে শেষ সরদারকে ভোলেননি আওয়ামী লীগপ্রধান এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে মরহুম আক্তার সরদারের মগবাজারের বাড়ি গিয়েছিলেন। সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি তিনি সবার খোঁজখবর নেন, তাদের মঙ্গল কামনা করেন।</p> <p>অনেক স্মৃতিবিজড়িত সরদার বাড়িতে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আক্তার সরদারের কর্মময় জীবন। এ বাড়িতে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার স্মৃতি রয়েছে। অনেকে এখানে এসে খাওয়া-দাওয়া করেছেন। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ বাড়ি থেকে খাবার সরবরাহ করা হতো। আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঘটনাও জানা যায়। এসব কিছুর মূলে ছিলেন  আক্তার সরদার।</p> <p>উল্লেখ্য, আক্তার সরদারের মৃত্যুর দুই দিন পর ২৯ এপ্রিল কালের কণ্ঠে ‘চলে গেলেন ঢাকার শেষ সরদার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে তাঁর সরদারি ও রাজনৈতিক জীবনের কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও চোখে পড়ে। আর গতকাল তিনি মরহুম আক্তার সরদারের প্রতি সম্মান জানাতে ওই বাড়িতে যান।</p> <p>সরদার বাড়ি সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার তাঁরা খবর পান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসবেন। ওই দিন এসএসএফ (বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী) সরদার বাড়িতে এসে নিরাপত্তার খুঁটিনাটি নিশ্চিত করে। আক্তার সরদারের ভাতিজি এবং সাবেক সংসদ সদস্য আসমা জেরিন ঝুমু বলেন, ‘এসএসএফের মাধ্যমেই জানতে পারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৩ তারিখ বিকেল ৫টায় আমাদের বাড়িতে আসবেন।’</p> <p>আক্তার সরদারের পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫টার দিকে সরদার বাড়িতে পৌঁছান। এসেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে যান তিনি। এসএসএফকে বলেন, ‘আপনারা দূরে সরে যান। এটা আমার নিজের বাড়ি। এখানে কেউ আমার ক্ষতি করবে না।’ সরদার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি প্রায় ৫০ মিনিট সময় কাটান। তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘এ বাড়ির সঙ্গে আমার বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এ বাড়ির অনেক অবদান। আক্তার সরদারকে আমার দেখার বড় শখ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা ও দোয়া রইল।’</p> <p>মরহুমের পরিবারের সদস্যদের জন্য শেখ হাসিনা খাবার ও বিভিন্ন উপহার নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয় পুরো পরিবার। তারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও শোক ভুলে যায়। প্রধানমন্ত্রীর উদারতা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না বলে জানান সাবেক সংসদ সদস্য আসমা জেরিন ঝুমু। তিনি যে কত মিশুক এবং জনদরদী সেটা তিনি না এলে বোঝা যেত না—মন্তব্য তাঁর।</p> <p>আক্তার সরদার শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনাকে কতটা ভালোবাসতেন তার একটি ঘটনা তাঁরা শেখ হাসিনাকে জানান। সেটা হলো, টেলিভিশনে শেখ হাসিনার ভাষণের সময় কোনো হইচই তাঁর কানে এলেই দূর থেকে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চাইতেন—‘আমার নেত্রীর কী হইছে!’ তাঁরা আরো জানান, আক্তার সরদার খুব সিগারেট খেতেন। অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কারো কথা শুনতেন না। যদি পরিবারের কেউ বলতেন, ‘আপনার সিগারেট খাওয়ার কথা শেখ হাসিনার কানে গেছে।’ তখনই বলতেন, ‘সত্যি আমার নেত্রীর কানে এ খবর গেছে? না এখন থেকে আর সিগারেট খাব না’—এই বলে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট ফেলে দিতেন। এসব কথা শুনে শেখ হাসিনা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হওয়ায় এই সরদার বাড়ির অনেকের ওপর বিভিন্ন সময় অনেক নির্যাতন-নিপীড়ন ও জেল-জুলুম হয়েছে। নির্যাতনে অনেকের অঙ্গহানিও হয়েছে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আক্তার সরদার। এ খবর শুনে তাঁর মা মারা যান। জিয়া-এরশাদ অনেক চেষ্টা করেও আক্তার সরদারকে তাঁর আদর্শ থেকে টলাতে পারেননি। এ কারণে তাঁরা তাঁকে অনেক হয়রানি করেছেন। এমনকি জেলে পর্যন্ত পুড়েছেন। কিন্তু দরাজ আত্মার এ মানুষটিকে শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ থেকে একচুলও সরানো যায়নি।</p> <p>আক্তার সরদারের ভাই শাহাবুদ্দিন সরদারের মেয়ে আসমা জেরিন ঝুমু ২৬ মার্চ গ্রেনেড হামলার সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফের পাশে মানবঢাল হয়ে নেত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে গুরুতর জখম হন। এর প্রতিদানও শেখ হাসিনা তাঁকে দিয়েছিলেন। গতবার তিনি মগবাজার-তেজগাঁও এলাকার সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বিদেশে তাঁর চিকিৎসা করালেও এখনো তিনি শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার বহন করছেন। যার অসহ্য যন্ত্রণা তাঁকে এখনো সহ্য করতে হচ্ছে।</p>