<p>বাড়তি কোনো যোগ্যতা নয়, কাজে দক্ষতারও বিশেষ কোনো শর্ত পূরণ নয়। শুধু সরকারের একটি সিদ্ধান্তের কারণে সর্বস্তরের অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সরকারি বেতনভুক্ত যেকোনো পেশাজীবীদের কেউ কেউ জুনিয়র হয়েও সিনিয়র হয়ে গেছেন। চলতি অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরিজীবীদের পাওনা ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার পর ১৫ ডিসেম্বর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট না দেওয়ার সিদ্ধান্তে এমন পরিস্থিতির সৃৃষ্টি হয়েছে। এতে সর্বস্তরের চাকরিজীবীদের অর্ধেকই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সিনিয়র হয়েও জুনিয়রের চেয়ে জুনিয়র হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।</p> <p>সচিবালয়ের কর্মকর্তা রেজাউর রহমান ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। গত তিন বছরে তাঁর তিনটি ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) যোগ হওয়ার পর বেতন দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪১০ টাকা। একই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা চয়ন রহমান একই পদে যোগ দিয়েছেন প্রায় এক বছর পর, ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর। চয়ন পেয়েছেন দুটি ইনক্রিমেন্ট। ফলে তাঁর বেতন</p> <p>দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৯৪০ টাকা। নতুন পে স্কেলের গ্রেডে ফেলার জন্য দুজনের বেতন সমান ধরা হয়েছে। অর্থাত্ উভয়েরই বেতন নির্ধারণ হয়েছে ১৭ হাজার ৬৪০ টাকা।</p> <p>গত ১ জুলাই থেকে ১৪ ডিসেম্বর নতুন বেতন কাঠামোর গেজেট জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত যাঁরা যোগদান করেছেন, তাঁরা সবাই চলতি অর্থবছরে একটি করে ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন। ফলে চয়ন রহমানও একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পেয়ে যান। এখন চয়ন রহমানের নতুন বেতন দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৫৩০ টাকা।</p> <p>চয়ন রহমানের এক বছর আগে যোগদানকারী রেজাউর রহমানের ইনক্রিমেন্ট যোগ হওয়ার কথা আগামী ১ জানুয়ারি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১৪ ডিসেম্বর গেজেট জারির পর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত কেউ কোনো ইনক্রিমেন্ট পাবেন না। ফলে ১ জানুয়ারির ইনক্রিমেন্টটি হাতছাড়া হয়ে গেছে রেজাউর রহমানের। এতে তাঁর বেতন ১৭ হাজার ৪১০ টাকাতেই পড়ে আছে।</p> <p>নতুন বেতন কাঠামোতে বলা হয়েছে, চাকরিজীবীরা যে যেদিনই যোগদান করুন না কেন, আগামী অর্থবছর থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই তারিখে ইনক্রিমেন্ট পাবেন তাঁরা। ফলে আগামী ১ জুলাই চয়ন রহমান একটি ইনক্রিমেন্ট পেলে তাঁর বেতন দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৬০ টাকা। আর রেজাউর রহমান একটি ইনক্রিমেন্ট নিয়ে বেতন পাবেন ১৮ হাজার ৫৩০ টাকা। তিনি আর কখনোই চয়ন রহমানের সিনিয়র তো নয়ই, তাঁর সমানও হতে পারবেন না।</p> <p>বেতন নির্ধারণী ফরমে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্য হয়েছেন, নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী শুধু তাঁদের বেতনের সঙ্গেই এই ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হবে। অর্থাত্ ১৫ ডিসেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত যাঁদের ইনক্রিমেন্ট যোগ হওয়ার কথা, তাঁদের বেতনের সঙ্গে সেটা যোগ হবে না। ফলে প্রায় অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বঞ্চনা কেবল সামান্য বেতন বৃদ্ধি নয়, জুনিয়র কর্মকর্তার চেয়ে নিজেকে বেতনের দিক থেকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। ফলে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও মর্যাদার প্রশ্নে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। অনেক বিসিএস কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p>রেজাউর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি সব কাগজপত্র সংগ্রহ করছেন। বৈষম্য নিরসনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গঠিত বেতনবৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে আবেদন করবেন তিনি। সেখানে ‘ন্যায়বিচার’ না পেলে আদালতে যাবেন। তিনি আরো বলেন, উচ্চ বেতনের বেসরকারি চাকরি ছেড়ে সরকারি চাকরিতে এসেছি সম্মানের জন্য। এখন উল্টো অসম্মান করা হচ্ছে। এ ঘটনায় সরকারের অর্ধেক কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ জুলাই থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ইনক্রিমেন্ট পান। আর বাকি অর্ধেক পান ১৫ ডিসেম্বর থেকে ৩০ জুনের মধ্যে। সরকারি কর্মচারী যদি ১৩ লাখ হন, তাহলে এ ঘটনায় সাড়ে ছয় লাখ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।</p> <p>তাঁদের মতো অবস্থা সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে কর্মরত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরসহ সর্বস্তরেই। কর্মকর্তারা জানান, সারা বছরই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কার্যক্রম চলে। সরকারি চাকরিতে যিনি এক দিন আগে যোগদান করেন, তিনি সব সময়ই এক দিন পরে যোগদানকারীর চেয়ে পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্তি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পান। এ জন্যই চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া মাত্রই অনেকে অনেক জরুরি কাজ ফেলে রেখে আগে যোগদান করেন। সরকার একই বছরে কাউকে ইনক্রিমেন্ট দিয়ে আর কাউকে না দিয়ে সিনিয়রদের এভাবে হয় জুনিয়রের সমান অথবা জুনিয়রের থেকেও জুনিয়র করে ফেলছে। এতে সর্বস্তরেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।</p> <p>অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশ ছিল, বছরের বিভিন্ন দিন আগের বছর ওই দিনে যোগদানকারীদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার পদ্ধতির কারণে সরকারের হিসাব-নিকাশে ঝামেলা হয়। ফলে বছরের কোনো সময় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তার সঠিক হিসাব করা যায় না। তাই যে তারিখেই যোগদান করুক না কেন, সবাইকে প্রতিবছর ১ জুলাই ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করে কমিশন। এ ক্ষেত্রে যাতে সরকারের বাড়তি অর্থ খরচ না হয়, সে জন্য চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য সবার একটি করে ইনক্রিমেন্ট বাতিল করার পক্ষে মত দেন তিনি। সচিব কমিটি ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত বেতন কাঠামোতেও এ সুপারিশ বহাল থাকে।</p> <p>তবে ভেটিংয়ের সময় আইন মন্ত্রণালয় মত দেয়, ইনক্রিমেন্ট হলো চাকরির অংশ। তাই কারো ইনক্রিমেন্ট কর্তন সরকার সুযোগ নেই। আইন মন্ত্রণালয় বলেছিল চলতি অর্থবছরের জন্য সবাইকে নির্ধারিত দিনে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার পর আগামী ১ জুলাই সবাইকে একসঙ্গে ইনক্রিমেন্ট দিতে। তাতে অর্থ মন্ত্রণালয় হিসাব করে দেখেছে, বাড়তি খরচ হবে ৯০০ কোটি টাকা। তাই ওই অর্থ সাশ্রয় করতে নতুন সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ১৪ ডিসেম্বর গেজেট জারির আগ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্টসহ সবার প্রাপ্য সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলসহ সব ধরনের সুবিধা বহাল রাখা হয়। আর ১৫ ডিসেম্বর থেকে এসব সুবিধা বাতিল করা হয়।</p> <p> </p>