কবিতা অঙ্কন : মাহবুবুল হক
ভাষার অরণ্যে আমি প্রতিদিন ছদ্মবেশে যাই। সেখানে একা একটি শমীবৃক্ষ। এর ছায়ায় গিয়ে চুপচাপ বসি। একে ঘিরে যে অব্যয় কাহিনি, আমিই এর শ্রোতা আর আমিই কথক।
বিজ্ঞাপন
নিজের এই দ্বৈত পরিচয়ে শব্দ করে হেসে উঠি। দু-টি লেজঝোলা পাখি বিরক্তিসহ মায়াসরোবরের দিকে উড়ে যায়। পায়ের কাছে চুপসে-যাওয়া একটা ফানুস এসে পড়ে।
সম্বিৎ ফিরে পাই। ভাবি, এইবার হাসি আর কথার সংযম। চাই আরো গূঢ় ছদ্মবেশ। অজ্ঞাতবাসের কালে পাণ্ডবেরাও এ-রকম ছদ্মবেশে ছিল। শমীবৃক্ষের খোঁড়লে তারা লুকিয়ে রেখেছিল অস্ত্রপাতি, ভুষা ও আভরণ।
নিতান্ত শখে ভাষার অরণ্যে আমি প্রবেশ করেছি। প্রতিটি ঝোপের ভেতর, গুহার ভেতর কুড়িয়ে চলেছি আদি বীরদের পরিত্যক্ত বর্ম ও আয়ুধ। আমি যেন বা তাঁদের একমাত্র জীবিত উত্তর পুরুষ। এক লোন ওয়ারিয়ার, দলছুট একাকী পাণ্ডব যেন আমি। ধমনিতে বয়ে চলা ক্ষাত্রতেজটুকুই আজ আমার সম্বল। আমার মৃগয়াপথ আপাতত গোপন থাকুক; আমার প্রয়োজন এমন এক ছদ্মবেশ, যা ধারণ করলে নিজের চেহারাকেও মনে হবে অন্যের।
বলো খুল্লতাত, বলো, আমি কি পাণ্ডব?
দ্রাঘিমার নিচে, কত চেনা-অচেনা নদীতীরে
কত উদয়-অস্ত ঘটে গেছে—আর,
কত কত মহাবলী হয়েছে নিথর!
ঝোলার ভেতরে যাবতীয় শব্দ-বাক্য-উপমা-প্রতীক আমি
যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছি।
জানি, সৌরমনীষার আঁচে একদিন স্থির হবে এদের প্রত্যয়;
রণধর্মে এরা বহু চক্রব্যূহ সাজিয়ে তুলবে—একে একে।
জানি, আমি বিফল হব না।
আপাতত ভাষাপাহাড়ের গোপন ফাটলে এসবকে ত্রস্তে আড়াল করি।
অগুনতি খোঁড়লের ভেতর চাপা দিয়ে রাখি আমার জিগীষা।
অতিউল্লাসের কম্পন যেন অসময়ে না দোলায় আমাকে।
আপাতত শমীবৃক্ষটিই ভরসা
স্ত্রীলোকের মতো এটি প্রগলভ নয়।
এরই খোঁড়লে আমি অক্ষরের পেয়েছি সিন্দুক; তাতে
প্রত্যহ জমিয়ে রাখছি ভবিষ্য যুদ্ধের সম্ভাব্য আয়ুধ।
চারপাশে জেগে উঠতে দেখছি অনন্ত কুরুর মাঠ;
অরণ্যের মধ্যস্থলে যে সরোবর, সেটি এক অস্থির আয়না।
এর জলে অনেক দূরের দৃশ্য দেখা দিয়ে চকিতে মিলিয়ে যেতে দেখি।
সীমাহীন-সংখ্যাহীন মহাবলিদানের ইশারা সেখানে;
বুঝে গেছি,
এক রণরক্তভরা পৃথিবীর দিকে আমাকে ছোটাতে হবে রথ।
অরি আর স্বজন সকলেই বধ্য সেখানে।
অক্ষরের সুরম্য মিনার, সে-ও, একঘেয়ে হয়ে ওঠে যদি,
নিজ হাতে ধ্বংস কাম্য এরও...
একদিন আত্মবধের খর্পর ঝলসে উঠবে গূঢ় অশ্লেষায়
ভাবছি, আমি কি অর্জুন?
শমীবৃক্ষটির নিচে আমরা দু-জন এসে দাঁড়িয়েছি আলাদা সময়ে।
আমি আর অর্জুন। আর ভাবছি, আমরা কী কারণে আলাদা!
একটি নীল অজগর ঘুমের ভেতর তার খোলস ছাড়ল;
নিজের খোলসটিকে এখন সে কি ভাবছে অন্য কারোর?
অর্জুনও কি ভাবছে,
আমি আর সে আদতে আলাদা কেউ?
ইত্যবসরে একটি হলুদ পাতা নিজেকে ঝরাল;
ঘুরে-ঘুরে নিচে নেমে আসবার সময় সে আমাকে বলল :
আদি বা অন্ত বলে কিছু নেই। মহাকালের ভেতর
তুমি আর অর্জুন একই লোক।
তখন আর এখন—দুটোই আদতে এক।
তীব্র উন্মোচনের আগে আপাতত লুকাও নিজেকে।
ভাষার এই অরণ্য শ্বাপদে ঠাসা।
এখানে বেড়ালের মতন নিঃশব্দে চলাই শ্রেয়;
চারপাশে ওত পেতে আছে বহু অচেনা বিপদ;
গুহাগুলি মাকড়জালে ঢাকা। ভেতরে জুলজুল করছে
প্রতিহিংসু জন্তুদের শ্যেন চোখ। শুকনো পাতায় পা-পড়ামাত্র
মচমচ আওয়াজ; ঘুমের ভেতরে নড়ে উঠছে মাংসাশীরা।
আপাতত ধরো আরো গূঢ় ছদ্মবেশ;
আপাতত বাকহীন, বাক্যহীন মূক ও বধির হ’য়ে থাকো।
আপাতত প্রতীকে মুড়িয়ে
শমীবৃক্ষটির কোটরে লুকিয়ে রাখো অরি-হননের বর্ম ও আয়ুধ!
জেনো,
অচিরেই ঝলকাবে তোমার কালো অক্ষরের তরবারি;
অচিরেই তোমার পতাকা পতপত
অচিরেই বহু-পরিমাণ বসন্ত ও কুহু
অচিরেই জয়!