উন্নত দেশ ও জাতিগুলো নিজেদের ঐতিহ্য বা প্রাচীন নিদর্শনগুলো আগলে রাখে। নিজেদের সম্ভ্রান্ত পরিচয়কে শাণিত করে। গর্বের সঙ্গে সেগুলো তুলে ধরে দুনিয়ার সামনে। তারা যে একটি প্রাচীন সভ্য জাতিসত্তার উত্তরাধিকারী, সেটা তারা অহংকারের সঙ্গে বলে বেড়ায়।
বিজ্ঞাপন
প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বগুড়ার মহাস্থানগড়। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই জনপদের নাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন। এই জনপদের রাজধানীটি কালের বিবর্তনে প্রোথিত হয়েছে মহাস্থানগড়ের ভূগর্ভে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই দুর্গনগরীর পশ্চিমাংশের সুরক্ষাবলয় ছিল কালীদহ সাগর। এই জনপদকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে বহু পৌরাণিক কাহিনি। এই সাগরের দক্ষিণ তীরেই রয়েছে একটি ভিটা, যেটি ‘পদ্মপুকুর’ নামে পরিচিত। আর বেহুলা-লখিন্দর কাহিনিখ্যাত বেহুলার শ্বশুর চাঁদ সওদাগর যে সর্পদেবী পদ্মার অভিশাপে সন্তানহারা হন, সেই সর্পদেবী পদ্মার বাড়ি এই কালীদহ সাগরেরই মাঝে, যাকে বলা হয় ‘পদ্মার ভিটা’। সেই বিশালাকায় জলাশয়ে ছিল নানা প্রজাতির সরীসৃপসহ জীববৈচিত্র্যের সমাহার। ঐতিহ্যবাহী সেই কালীদহ সাগর দ্রুত বিলীন হতে চলেছে। বিকেল থেকে শুরু হয়ে সারা রাত কালীদহ সাগর আর পদ্মার ভিটাসংলগ্ন স্থাপনাগুলোতে চলছে খননযন্ত্র তথা এক্সকাভেটরের ঘা। পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেখান থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। নিচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। কয়েক মাস ধরে এই ধ্বংসযজ্ঞ চললেও নীরব ভূমিকা পালন করছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন।
মহাস্থানগড় নিয়ে আগেও এমন অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রভাবশালী কিছু মানুষ সংরক্ষিত এলাকা দখল করে বাড়িঘর বা স্থাপনা নির্মাণ করছে। উপযুক্ত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা না থাকায় বহু নিদর্শন নষ্ট হয়ে গেছে। মূল্যবান জিনিসপত্র লাপাত্তা হয়ে গেছে। এমনকি ইট, টেরাকোটাও খুলে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। সংরক্ষিত এলাকায় সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও কেউ তা মানছে না। প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, যারা এসব দেখভাল করার কথা তারা অজানা কারণে দখলদারি বা লুটপাট দেখেও না দেখার ভান করে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রত্নতাত্ত্বিক কার্যক্রম ছাড়া সেখানে সব ধরনের খননকাজ নিষিদ্ধ করেছেন। আমাদের প্রশ্ন, তার পরও সেখানে খননযন্ত্র বসিয়ে মাটি কাটা হয় কিভাবে? প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খননকারীদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয় না কেন? রাতের আঁধারে খননের মাধ্যমে মূল্যবান নিদর্শন উদ্ধার ও পাচার করা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো বাধা দিচ্ছে না কেন? আর ‘অতি স্পর্শকাতর’ হিসেবে চিহ্নিত সংরক্ষিত এলাকায়ও স্থাপনা তৈরি হচ্ছে কিভাবে? জাতি হিসেবে এ সবই আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর ও দুঃখজনক।
আমরা আশা করি, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অবৈধ দখলকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।