<p>অসুখ না হলে চিকিৎসকের কাছে সাধারণত কেউ যায় না এবং তেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু ছোট হোক বা বড়, সুস্থ হোক বা অসুস্থ—প্রত্যেক মানুষের জন্যই বিভিন্ন বয়সে মেডিক্যাল চেক আপ বা রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। নিয়মিত মেডিক্যাল চেক আপের মাধ্যমে দেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অসুখগুলো নিরূপণ করে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে জটিলতা এড়ানো যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন</p> <p> </p> <p>রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা স্ক্রিনিংয়ের সাহায্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই রোগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু কার জন্য কোন স্ক্রিনিং, তা নির্ভর করে লিঙ্গ, বয়স, পারিবার, রোগের ইতিহাস ইত্যাদির ওপর। এ ধরনের পরীক্ষা পুরুষ-নারীভেদে কিছুটা আলাদা। এ জন্য ভবিষ্যতে জটিলতা এড়াতে বিভিন্ন বয়সে প্রত্যেকের কিছু না কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত।</p> <p> </p> <p><strong>বিশ</strong> <strong>বছর</strong> <strong>পর</strong></p> <p>সিবিসি : সিবিসি মানে হলো কম্প্লিট ব্লাড কাউন্ট। ব্লাড সেল টাইপ এবং ব্লাড সেলের কাউন্ট বা পরিসংখ্যান জানতে পরীক্ষাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা দেখে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন ব্লাড সেল স্বাভাবিক কি না, শরীরে কোনো ইনফেকশন আছে কি না, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কত ইত্যাদি। এই পরীক্ষা অনেক সার্জারি বা অপারেশনের আগেও করতে বলা হয়। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বা রুটিন চেক আপে এই পরীক্ষাটি করা দরকার।</p> <p> </p> <p>প্রি-ডায়াবেটিস চেক : ২০ বছর বয়সের পর প্রি-ডায়াবেটিস চেক করানো দরকার। বিশেষ করে ওজনাধিক্য থাকলে বা বংশে কারোর ডায়াবেটিস থাকলে এ ব্যাপারে বেশি সতর্ক হতে হবে।</p> <p> </p> <p>দাঁতের পরীক্ষা : দাঁতকে বলা হয় সার্বিক স্বাস্থ্যের জানালা। এ জন্য নিয়মিত দাঁতের পরীক্ষা ও ক্লিনিং বা স্কেলিং গুরুত্বপূর্ণ। দন্ত চিকিৎসকরা তাই প্রতি ছয় মাস পর পর ক্লিনিং বা স্কেলিং ও মুখের পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।</p> <p> </p> <p><strong>ত্রিশ</strong> <strong>বছর</strong> <strong>পর</strong></p> <p>লিপিড প্রোফাইল : রক্তের কোলেস্টেরল নির্ণয় করার পরীক্ষা এটি। ফাস্টিং কোলেস্টেরল টেস্ট বা খালি পেটে পরীক্ষাটি করা ভালো। এর মাধ্যমে এইচডিএল, এলডিএল, ট্রাইগ্লিসারাইড, ভিএলডিএল এবং টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা দেখা হয়। এইচডিএল হালো ভালো কোলেস্টেরল, যার মাত্রা বেশি থাকলে ভালো। কম হলে বিপত্তি ঘটতে পারে। আর এলডিএল হলো মন্দ কোলেস্টেরল, যার পরিমাণ কম থাকা ভালো।</p> <p> </p> <p>কিডনি ও মূত্রসংক্রান্ত : কারো কিডনি ভালোভাবে কাজ করছে কি না, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না, মূত্রনালিতে ইনফেকশন রয়েছে কি না—এসব জানতে ইউরিন আর/এম/ই, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ইলেকট্রোলাইট, ইউরিক এসিড পরীক্ষাগুলো মাঝেমধ্যে করা দরকার। এ ছাড়া রুটিন আল্ট্রাসনোগ্রাম করলে পিত্তথলি বা কিডনির পাথর, কিডনি ফুলে যাওয়া, প্রস্টেট বড় হওয়া, জরায়ুর টিউমার বা ডিম্বাশয়ের সিস্ট ইত্যাদি ধরা পড়ে।</p> <p>কারো কিডনি রোগ হোক বা না হোক, পূর্ণবয়স্ক প্রত্যেকের বছরে অন্তত একবার পরীক্ষাগুলো করা উচিত। আর যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে এবং বংশে কিডনি রোগী ছিল বা আছে, তাদের বছরে দুইবার এই পরীক্ষাগুলো করা উচিত।</p> <p> </p> <p>লিভার ফাংশন টেস্ট : নানা কারণে যকৃৎ বা লিভারের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু এটি বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। রক্তের SGPT পরীক্ষা করালে কিছুটা বোঝা যায়। এর মাত্রা প্রায়ই অনেকের বেশি থাকে; কিন্তু বেশির ভাগ কারণ থাকে ফ্যাটি লিভার বা যকৃতের কোনো গোপন সংক্রমণের কারণে। SGPT স্বাভাবিকের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি হলে অবশ্যই সজাগ হতে হবে। আবার পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম দেখেও বোঝা যাবে, লিভারে চর্বি জমেছে নাকি কোনো দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ, লিভার সিরোসিস ইত্যাদি হয়েছে। এ ছাড়া HBs-Ag পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে কি না বা হেপাটাইটিস পজিটিভ বা নেগেটিভ বোঝা যায়।</p> <p> </p> <p>থাইরয়েড : থাইরয়েড হরমোনের যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের কারণে শরীরে মারাত্মক পরিবর্তন হতে পারে। যেকোনো বয়সে থাইরয়েডজনিত সমস্যা হতে পারে, তবে সাধারণত ৩০ বছর বয়সের পর থেকে থাইরয়েড হরমোনের পরিবর্তন শুরু হয়। এ জন্য ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন বা T3,  থাইরক্সিন বা T4, TSH  নামের থাইরয়েডের কিছু পরীক্ষা করা দরকার। এর মাধ্যমে জানা যাবে অতিরিক্ত ওজন বাড়া, চুল পড়ে যাওয়া, নখ ভাঙা, অবসাদ অথবা অন্য কোনো রোগের কারণ সম্পর্কে। সাধারণত T4 হরমোনের বড় অংশ আবার T3 রূপান্তরিত হয়ে কাজ করে। ৩৫-ঊর্ধ্ব বয়সী, বিশেষ করে নারীদের চিকিৎসকের পরামর্শে এই পরীক্ষাগুলো করা দরকার।</p> <p> </p> <p>রক্তচাপ নির্ণয় : রক্তচাপ বেড়ে গেলে বা কমে গেলে এর তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে রক্তচাপ অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হতে পারে। নিয়ন্ত্রণে রাখলে বরং হার্টের নানা রোগ, কিডনি রোগের ঝুঁকি ইত্যাদি কমানো যায়। একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপের মাত্রা ১২০/৮০। তবে রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০ বা এর ওপরে হয়, তবে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলা হয়। এ জন্য প্রত্যেকেরই নিয়মিত রক্তচাপ মাপা উচিত। একটা বিপি মেশিন কিনে বাড়িতে রাখলে পরিবারের সবার জন্যই উপকার হয়।</p> <p> </p> <p><strong>৪০</strong> <strong>বছর</strong> <strong>পর</strong></p> <p>চক্ষু পরীক্ষা : গ্লুুকোমা, ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথিসহ অনেক চক্ষুরোগে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন উপসর্গ থাকে না। এ জন্য মাঝেমধ্যে চক্ষু পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। চক্ষু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চোখের কোনো সমস্যা আগেভাগে নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলে ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়ানো যায় বা দৃষ্টিশক্তি হারানো থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বয়স ৪০ হলেই চোখ পরীক্ষা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।</p> <p> </p> <p>ডায়াবেটিস : কারো ডায়াবেটিস আছে কি না বা থাকলেও মাত্রা কত—এটা জানতে আট ঘণ্টা বা এর অধিক সময় খালি পেটে থেকে রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া রক্তের HbA1c পরীক্ষা এবং গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা GTT পরীক্ষা করা উচিত। ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে সবারই ডায়াবেটিস নির্ণয়ে প্রতিবছর অন্তত দুইবার রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। বিশেষ করে পরিবারের অন্য কারো ডায়াবেটিস থাকলে বা অন্য কোনো ঝুঁকি থাকলে আরো আগেই এই পরীক্ষাগুলো করা উচিত। একান্ত সম্ভব না হলে, ডায়াবেটিস মাপার মেশিনে এক ফোঁটা রক্ত দিয়েও পরীক্ষাটি করে জেনে নেওয়া যায় কারো ডায়াবেটিস হয়েছে কি না।</p> <p> </p> <p>রেক্টাল টেস্ট : ৫০ বছরের পর থেকে প্রতিবছর এই স্ক্রিনিংটা করা জরুরি। বিশেষ করে পায়ুপথে রক্ত গেলে রেক্টাল টেস্ট করা জরুরি হয়ে পড়ে। অবহেলায় তা কোলন ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। বৃহদন্ত্রে বা কোলনের ভেতরের দেয়ালের পর্দা থেকে অস্বাভাবিক আঙুরের থোকার মতো গোটা বা পলিপ থেকেই বেশির ভাগ কোলোরেক্টাল সমস্যা বা ক্যান্সার হয়। এ জন্য রোগীকে অজ্ঞান করে পায়ুপথে নমনীয় ক্যামেরাযুক্ত টিউব ঢুকিয়ে কোলোনোস্কোপি পরীক্ষার মাধ্যমে অন্ত্রের ভেতরটা দেখা হয় এবং পলিপ পাওয়া গেলে ওই সময়ই ফেলে দেওয়া যায়। আবার রোগীকে অজ্ঞান না করেও অন্ত্রের নিচের দিকটি দেখা যায়। এর নাম ফ্লেক্সিবল সিগময়ডোস্কোপি পরীক্ষা।</p> <p> </p> <p>ভিটামিন ‘ডি’ : হাড়ের প্রয়োজনীয় গঠন, বৃদ্ধি ঠিক রাখার জন্য শরীরের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান ভিটামিন ‘ডি’। কম মাত্রায় থাকলে ভিটামিন ‘ডি’ ডিফিসিয়েন্সি দেখা দেয়। শরীরে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন ‘ডি’ থাকলে ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদরোগ এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সার থেকে শরীর সুরক্ষা দেয়। ইমিউন সিস্টেমের উন্নতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভিটামিন ‘ডি’। এই পরীক্ষাটি যেকোনো বয়সেই করানো যেতে পারে।</p> <p> </p> <p>প্রস্টেট স্ক্রিনিং : কারো প্রোস্টেট ক্যান্সার হোক বা না হোক, ৫০ বছরের পর থেকে যেকোনো পুরুষের বছরে একবার চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু স্ক্রিনিং করে পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই পরীক্ষাগুলো হলো : প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন (পিএসএ), আল্ট্রাসাউন্ড, বায়োপসি, কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি (সিটি স্ক্যান), ম্যাগনেটিক রেসোলেন্স ইমেজিং (এমআরআই), লিম্ফনোড বায়োপসি, প্রোস্টেট ক্যান্সার গ্রেডিং, স্টেজিং ইত্যাদি।</p> <p> </p> <p>আরো কিছু পরীক্ষা : উপরোক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও রুটিন চেক আপের জন্য ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম (হোল অ্যাবডোমেন) ইকোকার্ডিওগ্রাম, মল পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে, বিএমআই ইত্যাদি করা যেতে পারে। পাশাপাশি দাঁতের চিকিৎসক, ইএনটি বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।</p>