বর্তমান যুগ ফেতনা-ফাসাদের যুগ। এ যুগে দ্বীন ও ইমানের হেফাজত সবচেয়ে জরুরি কাজ। হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার ধরে রাখা যেমন কঠিন, তার চেয়েও ইমানের হেফাজত আরো কঠিন। অনেক ফেতনার বাহ্যিক ইসলামী আবরণের কারণে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান তার প্রকৃত রূপ সহজে ধরতে পারেন না।
এমন একটি জটিল ফেতনার নাম মওদুদী ফেতনা।
মওদুদী সাহেব তাঁর লিখিত বিভিন্ন বইয়ে নবী-রাসুলদের তথা ইসলাম সম্পর্কে যেসব বিরূপ মন্তব্য করেছেন, তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো। যেমন মওদুদী বলেন, 'নবীগণ মাসুম (নিষ্পাপ) নন। প্রত্যেক নবীর দ্বারাই কিছু না কিছু গোনাহ সংঘটিত হয়েছে'- (তাফহীমাত ২/৪৩)।
'কোনো কোনো নবী দ্বীনের চাহিদার ওপর অটল থাকতে পারেননি, বরং তারা নিজ মানবীয় দুর্বলতার কাছে হার মেনেছেন'- (তাফহীমুল কোরআন ২/৩৩৪)। 'নবী হোক বা সাহাবা হোক কারো সম্মানার্থে তার দোষ বর্ণনা না করাকে জরুরি মনে করা (মওদূদীর দৃষ্টিতে) মুর্তিপূজারই শামিল'- (তরজমানুল কোরআন, সংখ্যা ৩৫, পৃষ্ঠা ৩২) । 'হজরত ইউনুস (আ.) ঠিকমতো নবুয়তের দায়িত্ব পালন করেননি'- (তাফহীমুল কোরআন ২/৯৯) । 'হজরত ইব্রাহিম (আ.) ক্ষনিকের জন্য শিরকের গোনাহে নিমজ্জিত ছিলেন'- (তাফহীমুল কোরআন ১/৫৫৮)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে মওদুদী বলেন, 'মহানবী (সা.) মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি মানবিক দুর্বলতার বশবর্তী হয়ে গোনাহ করেছিলেন'- (তরজমানুল কোরআন, সংখ্যা-৮৫, পৃষ্ঠা-২৩০)। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সম্পর্কে মওদুদী বলেন- 'সাহাবাদের সত্যের মাপকাঠি জানবে না'- (দস্তুরে জামায়াতে ইসলামী, পৃষ্ঠা-৭)। শুধু তাই নয়, ইসলামের বহু মৌলিক পরিভাষা বিকৃত করার ধৃষ্টতা তিনি দেখিয়েছেন। মওদুদী মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইমান হরণের অপচেষ্টা চালিয়েছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নদওয়াতুর উলামার সাবেক শায়খুল হাদিস হজরত মাওলানা ইসহাক সিন্দিলভী সাহেব বলেন, ''মওদুদী সাহেবের কিতাব 'খিলাফত ও মুলুকিয়াত' পড়ে মনে হলো, মওদুদী সাহেব 'ছাবাই' ফেতনার মুজাদ্দিদ, চিন্তাধারায় একজন পাক্কা শিয়া। সাহাবিদের গালাগাল করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুন্নীদের শিয়া বানানোর ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন।'' মওদুদী সাহেবের পুত্র হায়দার ফারুক বলেন, 'বাবা (মওদুদী) উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ৯ সন্তানের কেউই দলটির রাজনীতিতে জড়াননি। বাবার রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য সন্তানদের ওপর পারিবারিক কোনো চাপও ছিল না। বরং তারা যাতে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতিতে না জড়ান, সেজন্য তিনি সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত রহস্য ছেলেমেয়েদের তিনি কোনো দিন বলেননি'- (সুত্র : বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ৬ ও ৮ অক্টোবর ২০১৩ এর সংবাদ)। তা ছাড়া উপমহাদেশের খ্যাতনামা উলামাদের প্রায় সবাই মওদুদী সাহেবের চিন্তাধারায় যেসব মারাত্মক ভুলভ্রান্তি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে, সে বিষয়ে জাতিকে সতর্ক করেছেন। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর প্রথম দিকের অনেক নেতাও মওদুদীকে সেসব ভুল-ভ্রান্তি প্রকাশ্যে প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু যখন দেখা গেল মওদুদী সাহেব তা প্রত্যাহার করার পরিবর্তে মানুষকে আরো বেশি গোমরাহির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, তখন তাঁরা একে একে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে ইসলামী দল থেকে পৃথক হয়ে গেছেন। উদাহরণত, জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মাওলানা মনজুর নো'মানী, সেক্রেটারি কমরুদ্দীন বেনারসী, মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্য হাকীম আবদুর রহীম আশরাফ, বিশ্ববরেণ্য মুসলিম মনীষী মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) প্রমুখসহ প্রথম সারির প্রায় আরো ৭০ জন নেতা জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন- (ফতোয়ায়ে রাহমানিয়া, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা. ৫৮)। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফি সাহেব বলেন, 'জামায়াতের সহযোগী না বলে বরং আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুন'- (কালের কণ্ঠ ৪-৪-২০১৩)। বর্তমানের জামায়াতে ইসলামীও কোনো ইসলামী দল নয়। তাদের বেশির ভাগ নেতা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, যেমনটা মওদুুদীরও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা ছিল না। তাদের দেহ-পোশাক ও কাজকর্মে ইসলামের বালাই নেই। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। সম্প্রতি খবর বের হয়েছে, জামায়াত নেতারা নিজেদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয় না, এমনকি রাজনৈতিক ধ্বংসাত্মক কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে তাদের ব্যবহার করে না; অথচ গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের মওদুদীবাদ শিক্ষা দিয়ে একদিকে যেমন তাদের ইমান হরণ করছে, অন্যদিকে তাদের জিহাদের নামে মানুষ হত্যা ও সম্পদের ক্ষতি সাধনে প্ররোচিত করছে। অতএব তাদের থেকে সাবধান!
লেখক : প্রফেসর, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়