দীনের মেহনত

ইসলামী আকিদা

মুফতি শাহেদ রহমানী
মুফতি শাহেদ রহমানী
শেয়ার
ইসলামী আকিদা

ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য বিশুদ্ধ আকিদা পোষণ অপরিহার্য। আকিদা শব্দটি আরবি 'আকদ' শব্দ থেকে নির্গত, যার অর্থ কোনো বিষয়ে দৃঢ়বিশ্বাস স্থাপন করা। ইসলামের পরিভাষায় আকিদা বলা হয় দৃঢ় ও মজবুত ইমান, অকাট্য প্রমাণভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত বিষয়াবলির প্রতি অন্তরের অটল বিশ্বাস ও তার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য।

পরকালে কোন শ্রেণীর লোকেরা মুক্তিপ্রাপ্ত হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিতে গিয়ে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, 'ইহুদি সম্প্রদায় বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, তেমনি নাসারারাও।

আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে এক দল মাত্র মুক্তিপ্রাপ্ত হবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি? উত্তরে রাসুল (সা.) ইরশাদ করলেন, 'যারা আমার এবং আমার সাহাবাদের মত ও পথের অনুসারী হবে' (তিরমিজি)।

এই হাদিসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যারা রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মত ও পথ অবলম্বন করে, তারাই আখিরাতে মুক্তিপ্রাপ্ত হবে।

যারা এই মত ও পথের অনুসারী, তাদের ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় 'আহলুস সুন্নাত ওয়ালা জামায়াত'। উপরোক্ত হাদিসের ঘোষণা দ্বারা স্পষ্ট যে, যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদায় বিশ্বাসী নয়, তারা ভ্রান্ত-বাতিল।

কোরআন ও হাদিসের অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামের আকিদাগুলো কী সে বিষয়ে অনেকেই জ্ঞাত নয়। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে সেসব আকিদা এমনভাবে তুলে ধরা হলো, যাতে একজন মুসলমান সহজে এগুলো বুঝতে ও স্মরণ রাখতে পারে।

১. আল্লাহ একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

২. আল্লাহর সত্তাও অনাদি, তাঁর গুণাবলিও অনাদি। (প্রাগুক্ত)

৩. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত সব কিছু অনিত্য, পরবর্তী সৃষ্ট। (শরহে আকায়েদ নাসাফিয়া)

৪. বিবেক, শক্তি ও চক্ষুদ্বয় আল্লাহ তায়ালার সত্তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

৫. আল্লাহ তায়ালা কারো মুখাপেক্ষী নন।

সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। (প্রাগুক্ত)

৬. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। (প্রাগুক্ত)

৭. আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব। তাঁর মৃত্যু নেই। (প্রাগুক্ত)

৮. আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ কেউ নেই। (প্রাগুক্ত)

৯. কোনো বস্তুতে আল্লাহ তায়ালার সাদৃশ্য নেই। (প্রাগুক্ত)

১০. আল্লাহ তায়ালা দৃশ্য-অদৃশ্য সব বিষয়ে জ্ঞাত। (প্রাগুক্ত)

১১. আল্লাহ তায়ালা সর্বদ্রষ্টা। কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য নয়। (প্রাগুক্ত)

১২. আল্লাহ তায়ালা নিচু ও উচ্চ- সব শব্দ শ্রবণ করে থাকেন। (প্রাগুক্ত)

১৩. আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই হতে পারে না। (প্রাগুক্ত)

১৪. আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান। কোনো কিছুই তাঁর শক্তির বহির্ভূর্ত নয়। (প্রাগুক্ত)

১৫. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন না, এমনকি নবীগণও নন, অলিগণও নন। (শরহে আক্বাইদ)

১৬. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কেউ হাজির নাজির (সর্বত্র উপস্থিত ও দর্শক) নন। এমনকি নবীগণও নন অলিগণও নন। (বাদাইউল কালাম ফি আক্বাঈদিল ইসলাম)

১৭. আল্লাহ তায়ালার কোনো সন্তান নেই, স্ত্রীও নেই। (সুরায়ে জ্বিন, আয়াত : ৩)

১৮. আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর স্রষ্টা। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

১৯. আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি বস্তুর (প্রাণীর) পরিমাণমতো রুজিদাতা। (প্রাগুক্ত)

২০. আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ব্যতীত না জীবন হতে পারে, না মৃত্যু। (প্রাগুক্ত)

২১. আল্লাহ তায়ালাই সব রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনিই সব প্রয়োজন পূরণকারী। (প্রাগুক্ত)

২২. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করা, কারো নামে মানত করা কুফরি। (সুরা হা-মীম সিজদা, আয়াত : ৩৫, সুরা মা-ইদাহ, আয়াত : ৩)

২৩. মৃতদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা শিরক। (বাদাইউল কালাম)

২৪. ভালো-মন্দ সব কিছুর সিদ্ধান্ত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হয়। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

২৫. সব নবী ও রাসুলের প্রতি ইমান রাখা। (শরহে আক্বাইদ)

২৬. সব নবীগণকে নিষ্পাপ মনে করা। (প্রাগুক্ত)

২৭. নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার বান্দা ও রাসুল। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

২৮. আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষ ও জ্বিনের প্রতি প্রেরিত। (প্রাগুক্ত)

২৯. তিনি সব রাসুলের সর্দার ও সর্বশেষ নবী। (প্রাগুক্ত)

৩০. নবী করিম (সা.)-এর জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করা সত্য। (শরহে আক্বাইদ)

৩১. তাঁর পর কোনো নবীই নেই, না মূল নবী, না ছায়া নবী। (বাদাইউল কালাম)

৩২. তাঁর পরে নবুওয়তের দাবিদার ও তাদের অনুসারীরা সবাই কাফের। (প্রাগুক্ত)

৩৩. হজরত ঈসা (আ.)-এর জীবিত থাকা এবং তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া সত্য। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৫৮)

৩৪. হজরত ঈসা (আ.) আমাদের রাসুল (সা.)-এর শরিয়তের অনুসারী হয়ে কিয়ামতের আগে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। (শরহে আক্বাইদ)

৩৫. হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর ছেলে হওয়ার ও তিন খোদার এক খোদা হওয়ার বিশ্বাসী ব্যক্তি কাফের। (সুরা মা-ইদাহ, আয়াত : ৭৩, সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৪৯)

৩৬. কোরআন ও হাদিস শরিফকে অস্বীকার করা, নবী করিম (সা.)-এর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা, শরিয়তকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরি। (বাদাইউল কালাম, শরহে আক্বাইদ)

৩৭. নবীগণের মুজিযা সত্য। (শরহে আক্বাইদ)

৩৮. নবীগণ নিজ নিজ কবরে জীবিত। (মুসনাদে আবি ইয়ালা)

৩৯. সাহাবায়ে কেরাম উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। (শরহে আক্বাইদ)

৪০. সব সাহাবায়ে কিরাম সমালোচনার ঊর্ধ্বে। (প্রাগুক্ত)

৪১. সাহাবায়ে কিরাম আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় বান্দা, তাঁরা দুনিয়ায়ই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০০)

৪২. সাহাবায়ে কিরামের মুহাব্বত ইমানের অংশ। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

৪৩. সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে দুশমনি রাখা, তাঁদের সমালোচনা করা মুনাফেকি। (প্রাগুক্ত)

৪৪. খোলাফায়ে রাশেদিনের মর্যাদা তাঁদের খিলাফতের ক্রমবিন্যাস মতে। (প্রাগুক্ত)

৪৫. সাহাবায়ে কিরাম পরস্পরের যুদ্ধ ও মতবিরোধে সবাই সত্যের ওপর ছিলেন। (প্রাগুক্ত)

৪৬. অলিগণ আল্লাহ তায়ালার নিকটতম বান্দা। (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৬২)

৪৭. তাঁরা মর্যাদায় নবীগণ ও সাহাবায়ে কিরাম থেকে নিচুস্তরের। (বাদাইউল কালাম)

৪৮. অলিগণের কারামত সত্য। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

৪৯. পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং চার ইমামের তাকলিদ করা অত্যন্ত জরুরি। (প্রাগুক্ত)

৫০. আল্লাহ তায়ালার সব ফিরিশতার ওপর ইমান রাখা। (প্রাগুক্ত)

৫১. আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত সব কিতাবের ওপর ইমান রাখা। (প্রাগুক্ত)

৫২. ইমান রাখা যে কোরআনে কারিম আল্লাহ তায়ালার কালাম বা বাণী। (প্রাগুক্ত)

৫৩. কোরআন শরিফ নাজিল হওয়ার পর আগের সব আসমানি কিতাব রহিত হয়ে গেছে। (শরহে আক্বাইদ)

৫৪. শেষ জামানায় ইমাম মাহদী (আ.)-এর খেলাফত সত্য। (মিশকাত শরিফ)

৫৫. দাজ্জাল ও ইয়াজুজ-মাজুজের বের হওয়া সত্য। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)

৫৬. পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া এবং বিশেষ ধরনের প্রাণীর আবির্ভাব হওয়া সত্য। (প্রাগুক্ত)

৫৭. কিয়ামতের অন্যান্য নিদর্শন এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া সত্য। (সহিহ বুখারি)

৫৮. কবরে মুনকার-নাকিরের প্রশ্ন এবং কবরের আজাব সত্য। (আকিদাতুত ত্বাহাভি)

৫৯. মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার জীবিত হওয়া এবং হাশরে উপস্থিত হওয়া সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬০. হাউজে কাউসার এবং সুপারিশ সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬১. আমলগুলোর ওজন এবং কিতাব বা আমলনামা প্রদান সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬২. পুলসিরাত, জান্নাত ও দোজখ সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬৩. আখিরাতে আল্লাহ তায়ালার দিদার বা সাক্ষাৎ সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬৪. পরকালে মুমিনদের সর্বদা জান্নাতে এবং কাফেরদের সর্বদা জাহান্নামে থাকা সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬৫. ফাসেককে কাফের বলা যাবে না, সে জাহান্নামে সর্বদা থাকবে না। (প্রাগুক্ত)

৬৬. আল্লাহ তায়ালার আরশ ও সিংহাসন সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। (প্রাগুক্ত)

৬৭. লাওহে মাহফুজ, কলম ও রূহের জগতের অঙ্গীকার সত্য। (প্রাগুক্ত)

৬৮. ইসলামই আল্লাহ তায়ালার কাছে একমাত্র পছন্দনীয় ধর্ম। (প্রাগুক্ত)

৬৯. ইসলাম ব্যতীত জাহান্নাম থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। (প্রাগুক্ত)

৭০. শরিয়তের বিধান চালু করার জন্য আমির নিযুক্ত করা অপরিহার্য। (শরহে আক্বাইদ)।

লেখক : সিইও, সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিকস বাংলাদেশ

rahmanictg@gmail.com

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ