লালনের শহর কুষ্টিয়ার থানাপাড়ার পরিচিত মুখ সদ্য কৈশোর পেরোনো রজনী অধিকারী। মোটরসাইকেল নিয়ে প্রতিদিন তাঁকে ছুটতে দেখে নগরবাসী। অনলাইনে অর্ডার করা খাবার মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন রজনী। অনলাইনে ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম ফুড প্যান্ডায় যে কজন নারী কর্মী রয়েছেন তাঁদেরই একজন ১৯ বছর বয়সী রজনী।
একসময় যেটাকে শুধু পুরুষের বাহন বলে মনে করা হতো, সেই মোটরসাইকেলে চড়ে রেস্তোরাঁ থেকে খাবার সংগ্রহ করে যথাযথ ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ। পুরো কুষ্টিয়া শহর তাঁর কর্মস্থল।
কুষ্টিয়া শহরেই বেড়ে উঠেছেন রজনী। এখানকার পথঘাট বেশ ভালো করেই চেনা তাঁর। বাবা-মা, চাচা-চাচি, ছোট দুই চাচাতো ভাই-বোন নিয়ে রজনীদের যৌথ সংসার। বড় বোন বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। বাবা একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। চাচা তেলের মিলের কর্মী। রজনীর মা আর চাচি গৃহিণী। ছোট থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখে বড় হওয়া মেয়েটি ফুড প্যান্ডায় যোগ দিয়েছেন বাড়ির সবার সমর্থন নিয়েই। একে তো নিজের শহর, তার ওপর কাজের প্রতি প্যাশন। ফলে কোনো কিছুই পথ আটকাতে পারেনি। এখন পাড়া-প্রতিবেশীসহ শহরের অন্যরাও মুগ্ধ তাঁর প্রচেষ্টা দেখে।
নিজ উদ্যোগে এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে মোটরসাইকেল চালানো শিখেছেন। মাত্র তিন দিন লেগেছিল যানটি বাগে নিতে। রজনীর স্বপ্ন ছিল ক্রিকেট খেলে বিশ্ব মাতাবেন। ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৮-তে খেলার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। মাথায় আঘাত পেয়ে বিদায় জানাতে হয় স্বপ্নের ক্রিকেটকে।
চটপটে স্বভাব আর অটুট মনোবলের রজনী অধিকারী সেখানেই থামতে পারতেন। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছা সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়েটিকে থামাবে কেন! তখনই যোগ দেন ফুড প্যান্ডায়। প্রতিষ্ঠানটিতে বেশ সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন।
রজনী পড়াশোনা করছেন কুষ্টিয়া আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে চতুর্থ সেমিস্টারে। ফুড পান্ডায় কাজ করার আগে আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রাইডার হিসেবে কাজ করেছেন তিন মাস। পড়াশোনায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য সেটা ছেড়ে ফুড প্যান্ডায় যোগ দেন। প্রতিদিন সকাল ১১টায় বেরিয়ে যান। ঘরে ফেরেন বিকেল ৫টায়। ফিরেই বসেন বইপত্র নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে একদিন ইউরোপে পাড়ি জমাবেন।
কাজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করলে হাসেন রজনী। জানালেন, বন্ধুরা কোথাও গেলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। বন্ধুমহলে সাহসী মেয়ে বলে বেশ পরিচিতি তাঁর। কথাটি মানেন রজনীও। তাঁর মতে, আত্মবিশ্বাস আর সাহস দিয়ে সব বাধা অতিক্রম করা যায়। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো অসুবিধা হয় কি না জানতে চাইলে বলেন, নিজের শহর বলে অনেকের সঙ্গেই চেনাজানা। তা ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তায় সব সময় সাহায্য পান প্রতিষ্ঠানের। তিনি কাজে কখন কোথায় যাচ্ছেন তা সার্বক্ষণিক মনিটর করা হয়। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি কোনো চিন্তা করতে হয় না। ফুড প্যান্ডার কুষ্টিয়া অফিসের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ফজলে রাব্বী বলেন, ‘একজন নারীকে কাজ দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানও নানা চিন্তা করেছে। কিন্তু রজনী সময়ের প্রতি খুবই যত্নশীল এবং পরিশ্রমীও। ভোক্তাদের ঠিকানায় সময়মতো খাবার পৌঁছে দেন। এজন্য তাঁর সুনাম আছে। এছাড়া তিনি বিনয়ী ও মিষ্টভাষী। তাঁর কাজের দক্ষতাও প্রমাণিত। ফুডপান্ডায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি ভালো কাজ করছেন।’ শহরের বাসিন্দা ও নিয়মিত ভোক্তা রোকসানা জামান বলেন, ‘খাবার অর্ডার করার পর খুব অল্প সময়ে ডেলিভারি দেন রজনী। প্রথমদিন রজনীকে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। একজন নারী হয়ে তিনি এই পেশায় এসেছেন, যা সত্যিই তাঁর সাহসেরই পরিচয় দেয়। তাঁর মতো সাহস নিয়ে এগিয়ে এলে নারীদের আর অবহেলিত হয়ে থাকতে হবে না।’
মন্তব্য