শিশুদের সঙ্গে বড়দের কথা বলা, তাদের কোনো কিছু শেখা ও শোনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। কিভাবে আচরণ করতে হয় অথবা প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়, শিশুরা তা বড়দের দেখে শেখে। বড়রা তাদের যেভাবে কথা বলা শেখায়, কোনো কিছু দেখতে শেখায় সেভাবেই তারা কথা বলে, দেখে ও সাড়া দেয়। মা-বাবারা সাধারণত তিন রকমভাবে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেন—
খিটখিটে মেজাজে
এমন মা-বাবার সন্তানরা কথাবার্তায় আগ্রাসী হয়। কথায় কথায় মেজাজ হারিয়ে ফেলে। অনেকটাই ভীতু স্বভাবের হয়। অহেতুক চেঁচামেচি করে, ঘন ঘন কথার অবাধ্য হয়।
অনুগত বা বিড়বিড় করে
এভাবে কথা বলা মা-বাবার সন্তানরা সহজে কথা শুনতে চায় না। অনেক সময় মা-বাবার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। মা-বাবার বেশি আদুরে স্বভাবের কারণে জেদি মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকে।
দৃঢ়প্রত্যয়ে
এটা সব বয়সী সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সবচেয়ে সেরা পদ্ধতি। যে মা-বাবা সন্তানের সঙ্গে দৃঢ়প্রত্যয়ে কথা বলেন, সেসব সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়। তারা কথাবার্তায় স্থির, সংগতিপূর্ণ, ইতিবাচক, উষ্ণ ও স্পষ্টভাষী হয়ে বেড়ে ওঠে। এ জন্য প্রত্যেক মা-বাবার উচিত সন্তানের সঙ্গে দৃঢ়প্রত্যয়ে কথা বলা।
এ জন্য শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় মা-বাবারা নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন।
নাম ধরে ডাকুন
সবার নিজ নিজ নাম তার কানে সংগীতের মতো শোনায়। শিশুরাও এর ব্যতিক্রম নয়। নাম ধরে ডাকা শিশুদের কোনো কিছু শোনার প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করে। শিশুরা একই সময়ে একাধিক বিষয়ের ওপর মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এ জন্য কথা বলার আগে শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ না করা পর্যন্ত তাকে নাম ধরে ডাকুন। যেমন—শিশু খেলায় ব্যস্ত থাকলে তাকে নাম ধরে ডাক দিন। ডাক শুনে খেলা বন্ধ করে আপনার দিকে তাকালে এরপর কথা বলুন।
ইতিবাচক ভাষা ব্যবহার করুন
শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় নেতিবাচক বাক্য পরিহার করুন। যেমন ‘গ্লাসটি ফেলে দিয়ো না’, ‘ঘরের মধ্যে দৌড়াবে না’, ‘শার্টে ময়লা করবে না’। এতে শিশুর মনে নেতিবাচকতার বিরূপ প্রভাব পড়ে। মনে করে, তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে অথবা তার কাজটি অন্যদের পছন্দ হচ্ছে না। পরিবর্তে, ‘গ্লাসটি খুবই সুন্দর, এটার খেয়াল রাখবে’, ‘শুধু ঘরের মধ্যে দৌড়াবে?’, ‘শার্টটিতে তোমাকে সুন্দর দেখায়, এটা পরিচ্ছন্ন রাখবে’—এভাবে কথা বলুন। ইতিবাচক ও ভালো কথা শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে, আচরণে পরিবর্তন আনে। শিশুরা এমন আচরণ অনুকরণ করতে শেখে এবং অন্যদের প্রতিও সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে।
সামনাসামনি কথা বলুন
শিশুর চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। প্রয়োজনে ঝুঁকে পড়ুন অথবা বসুন। এরপর কথা বলুন। শিশুরা বড়দের কথা বলার ধরন দেখে বুঝতে পারে যে তাদের কী করা উচিত। এটা শুধু তাদের ভালো আচরণই শেখায় না; বরং একে অন্যকে বুঝতেও সাহায্য করে। তাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়ার আগে নাম ধরে ডাকুন। আপনার চোখের দিকে তাকালে নির্দেশ দিন।
গলার স্বরের ব্যবহারে সচেতন হোন
শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় গলার স্বর সংযত রাখুন। সব সময় শিশুর সঙ্গে উচ্চ ও আগ্রাসী গলায় কথা বলবেন না। অনেক সময় মায়েরা রান্নাঘর থেকে উচ্চ গলায় শিশুদের কাজের তাড়া দেন। যেমন—টিভির শব্দ কমাও অথবা তাড়াতাড়ি স্কুলড্রেস পরে নাও। এটা শিশুকে এই বার্তা দেয় যে আপনি ব্যস্ত ও সিরিয়াস নন। এর বদলে রুমে যান, শিশুর সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্য যোগ দিন এবং বুঝিয়ে বলুন। মনে রাখুন, আপনি শিশুর জন্য রোল মডেল।
প্রশংসা করুন
‘তুমি সত্যি এটা করেছ!’, ‘রিয়েলি!’, ‘আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি’, ‘এটা অনেক আনন্দের!’, ‘এ বিষয়ে আরো কিছু বলো’—এজাতীয় কথা শিশুর সামনে বেশি বেশি বলুন। এতে শিশুরা সত্যিকার অর্থে উত্সাহ পায়। আরো বেশি বেশি প্রশংসা পাওয়ার আশায় ভালো আচরণ ও কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় শুধু ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলার পরিবর্তে পুরো প্রশ্ন অথবা বাক্য বলুন।
মনোযোগ দিয়ে শুনুন
শিশুর সঙ্গে শুধু আপনিই কথা বলবেন, তা নয়; বরং শিশুদেরও বলতে উত্সাহ দিন। শিশু কোনো কিছু বলার সময় মাঝপথে হস্তক্ষেপ করবেন না। পুরোটা শুনুন। কিছু বলার সময় বাধা পেলে শিশুরা মনোযোগ ও কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শিশুর কথা শেষ হলে তারপর আপনি বলুন। শিশুর সঙ্গে কথা বলার বা শোনার সময় মোবাইল অথবা অন্য কিছুর ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
মন্তব্য