<p> সেবার সেরাম শীত পড়েছিল ডিসেম্বরে। বিকেল হলেই কুয়াশারা ঝাঁপি খুলে বসত। সূর্য উঠত বেলা করে।</p> <p> সেমিস্টার ফাইনাল হয়ে গেলে ছুটি মিলেছিল সাত দিন। কোথায় গিয়ে মাথার জট খোলা যায়, ভাবতে ভাবতে রওনা হয়ে গেলাম।</p> <p> ভোরবেলায় পৌঁছলাম বান্দরবান। একবার ভাবলাম রুমা দিয়ে বগা যাই, আবার থানচি দিয়ে তাজিনডং যাওয়ার কথাও মনে এলো। বগা লেক আগেও গেছি। তাই থানচি তালিকার এক নম্বরে উঠে এলো। দুই বন্ধু এই-ই প্রথম এসেছে বান্দরবান-শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলাচল, নীলগিরি দেখার শখ তাদের। তাই চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে ফেললাম।</p> <p> সূর্য তখনো ওঠেনি, গাড়ি ছেড়ে দিলাম। শহর ছাড়ার আধা ঘণ্টা পরই শৈলপ্রপাত। পানি বেশি না থাকলেও পাখিদের কোলাহলে মুগ্ধ হলাম। সময় না থাকায় প্রপাত থেকে উঠে এলাম। তবে পাহাড় আবার দাঁড় করাল। মিলনছড়ির সামনে কুয়াশার সমুদ্র। চোখ ফেরানোর উপায় নেই।</p> <p> ধীরে ধীরে সূর্য পাপড়ি মেলে চাইল। কুয়াশার সাগরে লালের ঢেউ জাগল। আমরা জ্ঞান হারাতে বাকি রাখলাম। চিম্বুকে পৌঁছলাম ১০টা নাগাদ। বিজিবির ক্যান্টিনে ভুনা খিচুড়ি দিয়ে নাশতা সারলাম। তারপর গেলাম নীলগিরি। হেলিপ্যাডে বসে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি দেখলাম অনেকক্ষণ।</p> <p> জায়গায় জায়গায় স্টেশন দিয়ে থানচি পৌঁছলাম শেষ বিকেলে। বাজারের এক দোকানে ঠাণ্ডা ভাত খেতে খেতে আলোচনা করছিলাম, এখন তাজিনডং রওনা হওয়া উচিত হবে কি না। দুই বন্ধু আগে পাহাড়ে আসেনি বলে ভাবনা হচ্ছিল। আর শীতে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। পথে আঁধার ধরে বসলে বিপদ হতে পারে। অনেক চিন্তা করে রেমাক্রির পথ ধরলাম। তিন্দু পড়বে পথে। পত্রিকায় দেখেছিলাম-জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর। দুদিনের জন্য নৌকা ঠিক করে ফেললাম। বাজার-সদাই শেষে গোধূলির আলোয় নৌকা ভাসালাম সাঙ্গুতে।</p> <p> নৌকাটি ক্যানুর মতো। দৈর্ঘ্য প্রস্থের চার গুণ। জোড়া ছাড়া। যেতে যেতে নৌকা ডুবন্ত পাথরে আটকাল। মাঝিরা ঝটপট নেমে গেল পানিতে। দুজন মিলে ঠেলতে লাগল। পাথর ছাড়িয়ে পনেরো মিনিট যাওয়ার পর আবার আটকাল। এবার আমরাও নামলাম। পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তার ওপর শেওলা ধরা পিচ্ছিল পাথরে বারবার পা হড়কে যাচ্ছিল। ঠেলেঠুলে আলগা করে সন্ধ্যা গভীর করে ফেললাম। তেড়ে এলো বাতাস।</p> <p> একটি বাঁক ঘুরতে গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে পাহাড়ে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। বাবুল মাঝি বলল, 'ওটা তিন্দু বাজার। আমরা পৌঁছাই গেসি। আপনারা সামনে আগান। নৌকা রাইখা আসতেসি।' ততক্ষণে আমাদের শরীরের ফুয়েল শেষ।</p> <p> আকাশ ঘোরঘুট্টি। টর্চ বা হেড লাইট নেই সঙ্গে। আগুনটাও বেশ দূরে। গরম হয়ে নেওয়ার লোভে পা চালিয়ে দিলাম। তিন্দু ইউনিয়নের মহিলা মেম্বারের বাসায় থাকার বন্দোবস্ত হলো। মাঝরাত পর্যন্ত পাড়ার মুরব্বিদের সঙ্গে আগুনের ধারে বসে থাকলাম।</p> <p> পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বড় পাথর দেখতে। পুরো সাঙ্গু উপত্যকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে এগিয়ে চলেছি। অন্য কোনো জগতে চলে এসেছি ভ্রম হচ্ছিল। যেন নতুন গ্রহে অভিযানে বেরিয়েছি।</p> <p> চারদিকে সব স্তব্ধ। শান্ত, নীরব ও স্থির। যত এগিয়ে যাচ্ছিলাম প্রকৃতি দরজা খুলছিল একে একে। আমরা কথাও বলছিলাম না। সাদা কুয়াশার পর্দা ভেদ করে একসময় প্রবেশ করলাম পাথরের রাজ্যে। বিরাট বিরাট পাথর। দু-তিনটি তো প্রাগৈতিহাসিক মনে হলো। সাঙ্গু ফাঁকফোকর গলে বয়ে চলেছে। কোথাও কোথাও বাধা পেয়ে ফুঁসে উঠছে।</p> <p> হঠাৎ নৌকা আটকাল। কোনোমতে এদিক-ওদিক করে সবাই পাথরের ওপর নেমে হাঁটা ধরলাম। পাথর ডিঙানো সোজা কথা! প্রায় আধা ঘণ্টা লাগল শেষ বড় পাথরটায় পৌঁছতে। বুক ভরে তাজা বাতাস নিলাম। সামনে চোখ মেলে থির হয়ে গেলাম। সূর্যের সঙ্গে নদী আর নদীতে কুয়াশার অর্কেস্ট্রা-সব মিলে এক অবাক পৃথিবী। অতিপ্রাকৃতিক ভালো লাগায় ছেয়ে গেল শরীর-মন।</p> <p> কিভাবে যাবেন</p> <p> ঢাকার ফকিরাপুল থেকে এস আলম, সাউদিয়াসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে বান্দরবান যাওয়া যায়। ভাড়া ৬২০ টাকা। চান্দের গাড়িতে থানচি যেতে জনপ্রতি ভাড়া লাগে ২০০ টাকা। তিন্দু পর্যন্ত ছয়জন বসার মতো একটি নৌকার ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা।</p> <p>  </p>