৭টি উপজেলা এবং দুটি পৌরসভা নিয়ে বান্দরবান আসন গঠিত। একটি এলাকা ঘুরে আসতে লাগে তিনদিন। ফলে সবগুলো এলাকায় গিয়ে মানুষের সাথে দেখা করা নির্ধারিত ২১ দিনের মধ্যে সম্ভব নয়। দুর্গম এলাকাগুলো ঘুরতে ঘুরতে সময় কেটে গেলেও কোনো প্রার্থীই জেলা সদরের ভোটারদের সাথে এখনও হাত মেলাতে পারেন নি।
বান্দরবানে বীর বাহাদুর ও সাচিং প্রু টেনশনে
- ভোটগ্রহণের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, জাতীয় সংসদের ৩০০ নম্বর বান্দরবান আসনে প্রধান দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগের বীর বাহাদুর উশৈসিং এবং বিএনপির সাচিং প্রু দুজনের মনেই পুরো এলাকায় গণসংযোগ করতে পারা-না পারার টেনশন বাড়ছে। এই আসনে ইসলামী আন্দোলনের (হাতপাখা) প্রার্থী মুফতি শওকতুল ইসলাম নির্বাচনী যুদ্ধে তেমন একটা প্রভাব ফেলবেন-এমন ধারণা এখনো তৈরি করতে পারেননি। প্রতিবেদন : মনু ইসলাম, বান্দরবান
অন্যান্য

এর আগেও নির্বাচনের মাঠে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে তিনবার দেখা হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন ১৩তম বোমাং রাজার পুত্র ক্যসাইন প্রু বা কে এস প্রু। রাজ পরিবারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিসাব নিকেশ মেলাতে রাজ পরিবারের প্রবীণ সদস্য এবং পরে ১৫তম বোমাং রাজা অংশৈ প্রু চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যরা সমর্থন দেন বীর বাহাদুরকে।
এই নির্বাচনে সাধারণ পরিবার থেকে আসা বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন আদায়ে তিনি ব্যর্থ হন। মনোনয়ন বাগিয়ে নেন বোমাং রাজ পরিবারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অপর পক্ষের ঘুঁটি রাজপুত্র বধূ মিসেস মাম্যাচিং। তিনিও হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে।
দলীয় মনোনয়ন চেয়ে না পাওয়ায় নিজ দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা। তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। নির্বাচন বয়কট করায় বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরাও তৎপর ছিল প্রসন্ন ঘাঁটিতে। এর পরও বীর বাহাদুরের টানা পাঁচবারের বিজয় রথ থামাতে পারেন নি তারা কেউই।
এবারও জেতার আশায় বীর বাহাদুর উশৈসিং এবং সাচিং প্রু জেরী কোচা মেরে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যটা সাচিং প্রু জেরীর জন্যে একটু বেশি। নিরংকুশভাবে দলের মনোনয়ন পেয়েও সমর্থন পাচ্ছেন না জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের। এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘকালের হলেও এবারের বিভাজনটা অনেকটা স্পষ্ট। যদিও জেলা কমিটির সভাপতি মিসেস মাম্যাচিং, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন তুষার সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, ‘আমরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চাই। কিন্তু সাচিং প্রুর আচরণে মনে হচ্ছে নির্বাচনী মাঠে তিনি তাদের সহযোগিতা চান না।’
সমস্যা এত প্রকট না হলেও সিনিয়র নেতাদের প্রকাশ্যে কাজ করা নিয়ে বীর বাহাদুরও যে খুব একটা স্বস্তিতে আছেন-তাও নয়।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় জেলা কমিটির সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা দীর্ঘদিন যাবত বহিষ্কৃত আছেন। কেন্দ্রীয় অনুমোদন না পাওয়া গেলেও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাধারণ সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমানকে বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটি।
বর্তমানে যাঁরা এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, আইনগত কারণে নির্বাচনী মাঠে তারাও পুরোপুরি কাজ করতে পারছেন না।
জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি ক্যশৈহ্লা সম্পর্কের দিক থেকে বীর বাহাদুরের স্ত্রীর বড় ভাই হলেও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাহী দায়িত্ব পালন করায় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে তাঁর প্রকাশ্যে অংশ নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসলাম বেবীও বান্দরবান পৌরসভার মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান। ফলে তাঁকেও কাজ করতে হচ্ছে গা বাঁচিয়ে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত নবীন রাজনীতিকদের নিয়ে দুই প্রার্থীকেই কাজ করতে হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো দীর্ঘদিন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সব প্রান্তিক এলাকায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বীর বাহাদুরের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
অন্যদিকে সাচিং প্রু জেরীর পিতা অংশৈ প্রু চৌধুরী জিয়া সরকারের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি বোমাং সার্কেলের ১৫তম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। বোমাং রাজপুত্র এবং বান্দরবান সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকায় বিএনপি প্রার্থী সাচিং প্রু জেরীর জনপ্রিয়তাও সেই তুলনায় কম নেই।
মৌজা হেডম্যান, পাড়ার কার্বারিসহ পুরনো সময়ের মানুষের কাছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। জনবহুল এলাকা লামা, আলীকদম এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় সমর্থনের পাল্লাটা দু’প্রার্থীর পক্ষে প্রায় সমানে সমান। সফরে গেলে দু’প্রার্থীর সমাবেশে ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটছে এবং তাজা ফুলের মালায় তাঁদের দু’জনেরই গলা ভরে যাচ্ছে। এর পরেও সাচিং প্রু জেরী ভোটের সংখ্যা বাড়াতে পারবেন-এমন প্রত্যাশা তার কর্মীদের। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও বলেছেন, জনবহুল এলাকাগুলোই তাদের মূল টার্গেটে।
ভোটের ব্যবধান বাড়াতে তারাও চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে এবার জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী না থাকায় তারা সাচিং প্রু জেরীর পক্ষে কাজ করবেন বলে মনে করছেন প্রবীণ নাগরিকরা। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রচ্ছন্ন একটা সমর্থনও রয়েছে সাচিং প্রুর পক্ষে। দলে ফিরতে না পেরে বহিষ্কৃত প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা এবং কাজী মজিবের সমর্থনও তিনি পেয়ে যেতে পারেন।
তবে নির্বাচন সম্পর্কে অভিজ্ঞরা বলছেন, এমন ভোটের হিসেবের টেবিলটি এতটা সরল হতে পারে না। কারণ ভোটের দিন যত এগোচ্ছে, জনসংহতি কর্মীদের আনাগোনা বাড়ছে বীর বাহাদুরের দিকেই। বিশেষ করে তরুণ নেতা-কর্মীরা বীর বাহাদুরের ফিরে আসার বিষয়ে অনেকটা আগ্রহী।
এদিকে প্রবীণ ভোটাররা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর কর্মীরা নির্বাচন পরিচালনায় ততটা দক্ষ নয়। ফলে ভোটযুদ্ধে কারা ভোটারের মন বেশি জয় করতে পারবে-তা এখনই স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না।
তাঁরা বলেন, ঘরে ঘরে গিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্যাম্পিং-এর চেয়ে আনুষ্ঠানিকতায় দু’পক্ষের কর্মীদেরই ঝোঁক বেশি দেখা যাচ্ছে।
তবে বীর বাহাদুরের পক্ষে গান গেয়ে ক্যাম্পিং করে সাড়া জাগিয়েছেন স্থানীয় শিল্পী সমাজ। তারা প্রান্তিক এলাকাগুলোতে গিয়ে ভোট চাইছেন-এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সবাই।
সম্পর্কিত খবর