<p style="text-align: justify;">কুয়েতের এক বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ৪৫ জন ভারতীয়র প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। রুজি-রোজগারের টানে দেশ ছেড়ে কফিনবন্দি হয়ে ফিরলেন তারা। অধিকাংশের দেহের বেশির ভাগ অংশ ঝলসে গেছে। চেনার উপায় নেই। ডিএনএ পরীক্ষা করে জানতে হচ্ছে তাদের পরিচয়। এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠছে—কিভাবে আগুন লাগল? এমন অগ্নিকাণ্ড কি এড়ানো যেত না? সতর্কতার অভাব না কি অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ? ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা এক প্রতিবেদনে এসব প্রশ্ন খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখেছেন, ওই আবাসনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গ্যাস স্টোভ ব্যবহার করা হতো। রান্নার বিভিন্ন সরঞ্জামও ছিল অনুন্নত। শুধু তা-ই নয়, ওই ভবনে অগ্নিনির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। সিঁড়িও ছিল সংকীর্ণ। বিপদ ঘটলে ঘটনাস্থল ছাড়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু আগুনে ঝলসে মৃত্যু নয়। আগুন লাগার ফলে যে ধোঁয়া হয়, তাতে শ্বাস বন্ধ হয়েও মৃত্যু হয়েছে কয়েকজনের। হাওয়া-বাতাস খেলার জায়গা ছিল না ওই ফ্ল্যাটে। ফলে ধোঁয়া বের হওয়ার পথও ছিল না।</p> <p style="text-align: justify;">আগুন নেভার পর তদন্ত শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। ফরেন্সিক দল এসে নমুনা সংগ্রহ করে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ওই আবাসনের নিচতলায় নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরে প্রথমে শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লাগে। পরে দ্রুত সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতজন শ্রমিক একসঙ্গে থাকায় ওই ভবন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ ছিল না কারও। ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বিদ্যুতের তার। ছিল না উপযুক্ত ওয়্যারিং ব্যবস্থা।</p> <p style="text-align: justify;">ওই আবাসনে মোট ১৯৬ জন বাসিন্দা থাকতেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় সেখানে ছিলেন ১৭৯ জন। বাকি ১৭ জন বাইরে ছিলেন। ১৯৬ জনের মধ্যে ১৭৫ জনই ভারতীয়। বাকিরা ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও মিসরের বাসিন্দা।</p> <p style="text-align: justify;">এই অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের একজন ভারতের মেদিনীপুরের বাসিন্দা দ্বারিকেশ পট্টনায়েক। গত শনিবার সকালে কুয়েত থেকে বাড়ি ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। অনেক আশা বুকে নিয়ে কুয়েতে গিয়েছিলেন দ্বারিকেশের মতো শ্রমিকরা, চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। বুধবার ভোরের আগুনে সেই স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়।</p> <p style="text-align: justify;">কুয়েতের রাজধানীর দক্ষিণে মানগাফ এলাকায় ওই অগ্নিকাণ্ড গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে পারেননি অনেকেই। কেউ কেউ পালাতে পারলেও শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে এমন অনেকের।</p> <p style="text-align: justify;">রোজগারের আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে কুয়েতে ভিড় করেন শ্রমিকরা। বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেন তারা। মূলত দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে শ্রমিকরা কুয়েতে যান। অনেকের ধারণা, দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করা মানেই উন্নত জীবন লাভ করা। কিন্তু বাস্তবে সব সময় তা সম্ভব নয়। শ্রমিকদের জীবনধারণের মৌলিক অধিকারগুলোর মান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্নমানের হয়ে থাকে। একটা ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে বাস করেন অনেক শ্রমিক। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া ও রান্নাবান্না হয়। কুয়েতের যে বহুতলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেটাও ছিল তেমনই এক আবাসন। এক একটি ফ্ল্যাটে বাস করতেন সাত থেকে আটজন করে শ্রমিক।</p> <p style="text-align: justify;">কুয়েতে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৮ সালে আল আহমাদির এমন এক শ্রমশিবিরে অগ্নিকাণ্ড পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল। কম জায়গায় অতিরিক্ত মানুষের ভিড় ও অগ্নিনির্বাপনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবই ছিল সেই অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ।</p> <p style="text-align: justify;">শুধু কুয়েত নয়, ২০১২ সালে কাতারের দোহায় শিল্পাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সেবার ওই ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। শর্ট সার্কিটের কারণেই ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে দোহায় আবারও এক শ্রম এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের রিয়াদেও এমন এক অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল। ১০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল সেই ঘটনায়। আহত হয়েছিলেন কয়েক ডজন শ্রমিক। জানা যায়, রান্নাঘর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে আবু ধাবিতেও একইভাবে অগ্নিকাণ্ড হয়।</p> <p style="text-align: justify;">জীবনযাত্রার অনুন্নত মানের জন্যই বারবার বিভিন্ন দেশের শ্রমিক এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাতেও বিশেষ ব্যবস্থা দেখা যায় না। অনেকে আবার এমন জীবনযাত্রার জন্য অবৈধ নিয়োগকেও দায়ী করছেন। শাহরুখ খান অভিনীত ‘ডাঙ্কি’ ছবি দেখে অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট, উপযুক্ত নথি ছাড়াও সীমান্ত পেরিয়ে কিভাবে বিদেশে ভিড় করছেন ভিনদেশের নাগরিকরা। নথি না থাকলে বিদেশে লুকিয়েই থাকতে হয় শ্রমিকদের। ফলে সুযোগ-সুবিধাহীন এলাকায় মানুষ থাকতে বাধ্য হন। কিছু ক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়। অসহায়তা গ্রাস করে তাদের।</p> <p style="text-align: justify;">কুয়েতের ঘটনা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কিভাবে মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে কাজ করছেন। নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে উপার্জনের বেশির ভাগ টাকাই পাঠিয়ে দেন নিজের বাড়িতে। আর অল্প টাকায় কোনো রকমে দিন কাটান তারা!</p>