<p>রাশিয়ায় কারাগারে বন্দি বিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং ক্রেমলিনের স্পষ্টভাষী সমালোচক আলেক্সাই নাভালনি শুক্রবার আর্কটিক সার্কেল কারাগারে মারা গেছেন। রুশ জেল কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচকদের মৃত্যুর দীর্ঘ সারির মধ্যে সাম্প্রতিকতম ঘটনা এটি, যারা বছরের পর বছর ধরে জেলে, নীরব বা নির্মম পরিণতির মুখোমুখি হয়েছেন। বিমান দুর্ঘটনা, জানালা থেকে দুর্ঘটনাজনিত পতন, ফাঁসি, বিষক্রিয়া এবং স্বাস্থ্য সমস্যা—রুশ প্রেসিডেন্টের অনেক সমালোচককে বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অনেক মৃত্যুর ঘটনার কখনোই সমাধান হয়নি এবং সেগুলো দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।</p> <p>কয়েক বছর ধরে রুশ নেতার সমালোচনা করা কিছু হাই-প্রফাইল ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা :</p> <p><strong>ইয়েভগেনি প্রিগোজিন</strong><br /> আধাসামরিক গোষ্ঠী ওয়াগনারের সাবেক প্রধান একসময় দেশটির অন্যতম শক্তিশালী অলিগার্চ এবং পুতিনের বিশ্বস্ত অভ্যন্তরীণ বৃত্তের সদস্য ছিলেন। তিনি ২০২৩ সালে ৬২ বছর বয়সে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। ইউক্রেনে মস্কোর যুদ্ধের দিকনির্দেশনার সঙ্গে মতানৈক্যের জন্য প্রিগোজিন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার দুই মাস পর ব্যাখ্যাতীত দুর্ঘটনাটি ঘটে।</p> <p>প্রিগোজিন একটি নাটকীয় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে ২০২৩ সালের জুন মাসে সশস্ত্র লোকদের রাশিয়ার রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে দেখা গিয়েছিল। পুতিন নীরব ছিলেন এবং বিদ্রোহ হঠাৎ স্থগিত হয়ে যায়। প্রিগোজিন তাঁর সেনাদের অস্ত্র ধারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা রাশিয়ার মিত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেংকোর মধ্যস্থতায় একটি চুক্তির অধীনে সে দেশে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু দুই মাস পর প্রিগোজিন মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার সময় তাঁর বিমানে স্পষ্টতই একটি বিস্ফোরণ ঘটেছিল।</p> <p>তবে ক্রেমলিনের সমালোচক এবং পশ্চিমা দেশগুলো প্রিগোজিনের মৃত্যুর জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছে। ক্রেমলিন অবশ্বিয মান ভূপাতিত করার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। </p> <p><strong>বরিস নেমতসভ</strong><br /> ক্রেমলিনের সোচ্চার সমালোচক বরিস নেমতসভ নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিনের অধীনে উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মস্কোর ক্রেমলিনের কাছাকাছি একটি সেতুতে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।</p> <p>সিএনএনের তথ্য অনুসারে, পুতিনের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য তাঁকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যখন তাঁকে হত্যা করা হয়, তখন তিনি ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি সমাবেশ স্থাপনে সাহায্য করছিলেন, যেটি ক্রিমিয়ার সংযুক্তি এবং পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসে কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল।</p> <p><strong>বরিস বেরেজভস্কি</strong><br /> শক্তিশালী রুশ ব্যবসায়ী ক্রেমলিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব জড়িয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তিনি তাঁর সম্পদ সঞ্চয় করেন, যার বড় একটা অংশ এসেছে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি থেকে। কিন্তু তাঁর সম্পদ এবং রাজনৈতিক প্রভাব আকাশচুম্বী হয়, যখন তিনি রুশ গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। পুতিনের সরকারের অনুগ্রহ হারানোর পর তিনি ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হন। </p> <p>২০১৩ সালে বেরেজভস্কিকে তাঁর যুক্তরাজ্যের বাড়ির বাথরুমের মেঝেতে গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্রিটিশ পুলিশ সে সময় বলেছিল, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।</p> <p><strong>আলেকজান্ডার লিটভিনেনকো</strong><br /> লিটভিনেঙ্কো ছিলেন একজন সাবেক রুশ গুপ্তচর। পরে তিনি ক্রেমলিনের সমালোচক হয়ে ওঠেন। সিএনএনের প্রতিবেদন অনুসারে, একটি ব্রিটিশ তদন্তে বলা হয়েছে, আলেকজান্ডার লিটভিনেনকোকে ২০০৬ সালে লন্ডনের একটি হোটেল বারে দুই রুশ এজেন্ট বিষ প্রয়োগ করেছেন। তাঁর গ্রিন টিতে অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম-২১০ মেশানো হয়েছিল।</p> <p>লিটভিনেনকো সব সময় জোর দিয়ে বলতেন, পুতিন ও ক্রেমলিন তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছে তার জন্য দায়ী। কিন্তু ক্রেমলিন সব সময় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বিষ প্রয়োগে অভিযুক্ত দুই এজেন্টকে ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছে।</p> <p><strong>রাভিল ম্যাগানভ</strong><br /> রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী লুকোইলের বোর্ডের চেয়ারম্যান রাভিল ম্যাগানভ ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রকাশ্যে সমালোচনা করার ছয় মাস পর মারা গেছেন। মস্কোর একটি হাসপাতালের জানালা থেকে পড়ে তিনি মারা যান। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে খবর প্রকাশ করেছে।</p> <p><strong>আনা পলিটকভস্কায়া</strong><br /> পলিটকভস্কায়া ছিলেন চেচনিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধের একজন সোচ্চার সমালোচক। ২০০৬ সালের অক্টোবরে মস্কোতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশপথে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ২০১৪ সালের জুনে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পাঁচজনকে শাস্তি দেওয়া হয়। তবে কে এ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তা এখনো স্পষ্ট নয়।</p> <p>কিন্তু পলিটকভস্কায়ার মৃত্যুর পরপরই পুতিন তাঁর হত্যাকাণ্ডে ক্রেমলিনের কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বলেছিলেন, পলিটকভস্কায়ার ‘মৃত্যু রাশিয়া এবং চেচেন প্রজাতন্ত্র—উভয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষের জন্য তাঁর কার্যকলাপের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক।’ </p> <p><strong>সের্গেই ম্যাগনিটস্কি</strong><br /> সের্গেই ম্যাগনিটস্কি ছিলেন একজন রুশ কর উপদেষ্টা। তিনি একটি দুর্নীতির বিষয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে বিনা বিচারে আটক করা হয়েছিল এবং মুক্তি পাওয়ার ঠিক সাত দিন আগে তিনি কারাগারে মারা যান। তিনি ২০০৮ সালে গ্রেপ্তার হন এবং ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর মারা যান।</p> <p><strong>আলেকজান্ডার পেরেপিলিচনি</strong><br /> পেরেপিলিচনি ছিলেন একজন অর্থদাতা, যিনি ২০১০ সালে কিছু তথ্য ফাঁস করে আলোচনায় আসেন। তিনি রুশ কোষাগার থেকে ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল চুরির বিবরণ দেখিয়ে সুইস কর্মকর্তাদের কাছে নথি হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি ২০০৯ সালে রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর ২০১২ সালে লন্ডনের কাছাকাছি জগিং করার সময় মারা যান। যদিও তিনি সম্ভবত প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। </p> <p>ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও সিএনএনের তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে অন্তত ১৩ জন হাই-প্রফাইল রুশ ব্যবসায়ী আত্মহত্যা বা রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।</p> <p>সূত্র : এনডিটিভি</p>