<p>‘অ্যাস্টন মুর’ কেচ্ছায় তুমুল সমালোচিত হয়েছিলেন আলী আজগার লবি। অনেক দিন আগের কথা। অতশত অনেকের মনে থাকার কথাও নয়। ঘটনা হলো, একুশ শতকের শুরুতে ক্রিকেটের টিভিস্বত্ব বিক্রির জোর চেষ্টা চলছিল। সেই মূহূর্তে অ্যাস্টন মুর নামক একটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে বসেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তত্কালীন সভাপতি। সেই আবেদনপত্র কিংবা চুক্তি ক্রিকেটের ‘স্বার্থবিরোধী’ ছিল, অগত্যা মোটামুটি কেটে-ছিলে বোর্ড সভাপতির ভাবমূর্তিতে লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল।</p> <p>দীর্ঘদেহী, সুদর্শন আলী আজগার এই সমালোচনায় আরো রেগে টকটকে লাল! যাকে পান, তাকেই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই স্বাক্ষরে মোটেও ক্রিকেট ‘বিক্রি’ হয়ে যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অ্যাস্টন মুর নামের প্রতিষ্ঠানটি তাঁর অচেনা। টিভি সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রির মার্কেটিং এজেন্ট হিসেবে নিযুক্তির এই প্রস্তাব বোর্ড সভাপতির সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁরই এক সহকর্মী। তিনি শুধু স্বাক্ষরটি করেছিলেন।</p> <p>বিতর্কের সেই স্রোতে অ্যাস্টন মুর কোথায় ভেসে গেছে, কে জানে! সেই বিস্মৃতির পর রেকর্ড ৫৬ মিলিয়ন ডলারে নিমবাসের কাছে টিভি সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেছিল বিসিবি। মার্কেটিংয়ে সর্বোচ্চ দক্ষতার কারণে প্রভূত প্রশংসিত হয়েছিল বোর্ড। কিন্তু পরে জানা গেল, এই চুক্তি ছিল বকলমে একটা ‘স্ক্যাম’! ফলে চুক্তিমূল্যের সামান্যই পেয়েছিল বিসিবি। </p> <p>এই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটির কারণ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীর সাম্প্রতিক একটি বয়ান। আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা) বেশ কিছুদিন ধরেই বাফুফের ওপর আতশকাচ ফেলে খোঁজাখুঁজি করছে। সেই খোঁজাখুঁজি দুর্নীতির। সে মতে শাস্তিও জুটেছে ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কয়েকজন কর্মচারীর। ফুটবলবিশ্বের মানচিত্র আর প্রতাপ বিবেচনায় প্রথম দফায় ঘোষিত শাস্তিই বাফুফে টলিয়ে দেওয়ার কথা। সর্বশেষ অভিযোগ ও শাস্তির ঘোষণা তো ভয়াবহ। আর্থিক অনিয়মের দায়ে জরিমানা করা হয়েছে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদীকে, পদাধিকারে যিনি বাংলাদেশের ফুটবল প্রশাসনের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি। </p> <p>ফিফার ই-মেইল আসার পর কালের কণ্ঠের নিউজরুমে রীতিমতো হুড়াহুড়ি। ক্রিকেটে মত্ত দেশ হলেও ফিফা, ফুটবলের পরিধি কে না বোঝে। সেই ফিফা শাস্তি দিয়েছে দেশের ফুটবল ফেডারেশনের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তিকে—অবশ্যই বড় খবর। আক্ষেপের হলো, সেই খবরটি লজ্জার। </p> <p>কালের কণ্ঠের ক্রীড়া বিভাগের যিনি ফুটবল রিপোর্টিং করেন, তিনি লজ্জিত। খেলাধুলার বাইরের জগতের নিউজরুম ম্যানেজমেন্টের সবাইও বিব্রত। পরের ২৪ ঘণ্টায় চোখ-কান খোলা রেখে দেখি শুধু একজনের প্রতিক্রিয়ায় লজ্জার ছাপ নেই, বিব্রতও নন তিনি। তিনি স্বয়ং সালাম মুর্শেদী! </p> <p>তিনি লজ্জিত নন, কারণ যে পরিমাণ তহবিল তছরুফের দায়ে শাস্তি দিয়েছে ফিফা, চাইলে সেই পরিমাণ অর্থ বাতাসে উড়িয়ে দিতে পারেন সালাম। ফিফা তাঁকে জরিমানা করেছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। এনভয় নামের বিশাল গ্রুপের কর্ণধারের জন্য এই জরিমানা অঙ্ক অতি সামান্য।</p> <p>জরিমানার অঙ্ক সামান্য, তবে ‘কলঙ্ক’ ভারি। সেই ভারি কলঙ্কটাই মনে দাগ কাটতে পারছে না সালাম মুর্শেদীর! তিনি দিব্যি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ওরা (কর্মচারীরা) কাগজ নিয়ে আসত, আমি স্বাক্ষর করে দিতাম।’ যেমনটা এক সহকর্মীর বাড়িয়ে দেওয়া অ্যাস্টন মুরের আবেদনপত্রে অনুমোদন করা স্বাক্ষর দিয়েছিলেন আলী আজগার লবি। তবে সেই ভুলের সঙ্গে সালামের দায় এড়িয়ে যাওয়া এক বিষয় নয়। অ্যাস্টন মুর সমালোচনার স্রোতেই হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সালামকে ফিফার মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা সুনির্দিষ্ট অভিযোগে শাস্তি দিয়েছে। এটি হালকা করে দেখার কিংবা বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি দায় আছে সালাম মুর্শেদীর।</p> <p>প্রথমত, ফিফা শাস্তি দিয়েছে তদন্ত শেষে। তিনি সেই শাস্তি মেনে নিয়েছেন, জরিমানার অর্থও নাকি দ্রুত পরিশোধ করে দেবেন। তাঁর দ্বিতীয় দায়টি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের হালহকিকতের জন্য অশনিসংকেত। নিজের দায় এড়াতে সালাম দিব্যি বলে দিয়েছেন যে কর্মচারীদের তৈরি করা হিসাবপত্র পর্যবেক্ষণ না করেই স্বাক্ষর করে দিতেন তিনি। কী ভয়াবহ! বাফুফের অর্থ কমিটির প্রধান চোখ বুজে ভুয়া ভাউচারে স্বাক্ষর করে গেছেন দিনের পর দিন! এসব বলার সময় তাঁর অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল, যাবতীয় ভুল কর্মচারীদের। তিনি তো সরলমনে স্বাক্ষর করেছেন শুধু। ভাবতে অবাক লাগে, ব্যবসার বিশাল সাম্রাজ্য গড়া একজন ব্যক্তি না দেখেই স্বাক্ষর করছেন।</p> <p>নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করেন না সালাম মুর্শেদী। করেন না কারণ, ওটা তাঁর রুটিরুজি। আর বাফুফের ভুয়া ভাউচারে চোখ বুজে স্বাক্ষর করেন, এটায় তাঁর নিজের স্বার্থ সরাসরি জড়িত নয় বিধায়। চুরিচামারি হলে বাফুফের হবে, তাঁর নিজের তো আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির (তখন তো আর জানতেন না যে এক দিন ১৩ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে!) কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ বাফুফের অর্থকষ্টের ব্যাপারটি কারোরই অজানা নয়। সালাম মুর্শেদীর মতো ব্যবসায়ীদের সেই অর্থকষ্ট দূর করার ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি উল্টো অর্থনাশে সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছেন, সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে।<br /> সজ্ঞানে করলে তবু ভালো ছিল। আমজনতা ধরে নিত, তিনিও চোর! কিন্তু সালাম বলছেন, সবই হয়েছে তাঁর অজ্ঞাতে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের সমুদয় দায়দায়িত্ব অর্থ কমিটির প্রধানের। তাই অন্যের ওপর দায় চাপানোর কোনো উপায় নেই। এর পরও যিনি এমন চাপানউতোর করেন, তিনি কার্যত একজন সুযোগসন্ধানী। ফুটবলে নিষিদ্ধ সাবেক সাধারণ সম্পাদক কিংবা আর যে তিন কর্মচারীর সাজা হয়েছে, তাতে দায় আছে সালাম মুর্শেদীর। এখন সেই দায় এড়াতে তিনি যেসব কুযুক্তি দিচ্ছেন, তা আরো উদ্বেগজনক।</p> <p>উদ্বেগের কারণ হলো, একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া দেশের আর কোনো ফেডারেশনই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। তো, এখন সব ফেডারেশনের অর্থ বিভাগের প্রধান যদি সালামের মতো ভুয়া ভাউচারে দিনের পর দিন স্বাক্ষর করে যেতে থাকেন, তার পরিণতি কী হবে? </p> <p>আচ্ছা, ধরে নিলাম, এত দিন সরল বিশ্বাসে ভাউচারে স্বাক্ষর করেছেন সালাম মুর্শেদী। তবু রীতিবিরুদ্ধ এই কাজ কখনোই আত্মপক্ষ সমর্থনের ঢাল হতে পারে না। এটাকে যিনি ঢাল বানানোর চেষ্টা করবেন, তাঁকে ওই প্রতিষ্ঠানে পরিহার করাই শ্রেয়। আত্মপক্ষ সমর্থনে কুযুক্তি উপস্থাপনের মানসিকতা সেই ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানকেও পিছিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গিয়ে ঠেকে তলানিতে।</p> <p>অবশ্য সালাম মুর্শেদীর কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু প্রত্যাশা অবান্তর। প্রথম দফায় ফিফার অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শাস্তির খবর শোনার পর বাফুফের কর্মকাণ্ডের ‘টাইমলাইন’ মনে করে দেখুন। ফিফার তীর যেহেতু আর্থিক অনিয়মে, সেহেতু বিষয়টির চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়ার পর্যন্ত স্বপদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার শিষ্টাচার দেখাননি সালাম। বাফুফেও সে রকম কোনো পরামর্শ তাঁকে দিয়েছিল বলে শোনা যায়নি। ফিফার বিস্ফোরক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি লোক-দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বাফুফে। আর্থিক অনিয়মের সেই কমিটির সামনে সালাম মুর্শেদীর হাজির হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি। তদন্ত শেষে পাওয়া গেল ‘অশ্বডিম্ব’, ফিফার তদন্ত প্রতিবেদনটিই বাংলায় তর্জমা করে চালিয়ে দেওয়া হলো! আমরা নীরবে দেখে গেলাম, সালাম মুর্শেদীর ‘অজ্ঞানতা’র ব্যাখ্যা শুনেও গেলাম। ‘ক্লিনচিট’ পাননি, উল্টো ফিফার জরিমানার প্রতিক্রিয়া এমনভাবে করছেন যেন এসব ডাল-ভাত!   </p> <p>এই ‘ডাল-ভাত’ প্রসঙ্গে আবার পুরনো একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। প্রয়াত ফজলুর রহমান পটল তখন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। বাফুফের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দেওয়ায় বাংলাদেশের ফুটবলকেই নিষিদ্ধ করেছিল ফিফা। অবশ্য এমনিতেই তখন ফুটবল ঠিকঠাক চলছিল না। তবে ফিফার নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই বিশাল খবর। কিন্তু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সম্মেলনকক্ষে ঘরভরা সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল পরিস্থিতির তাত্পর্য অনুধাবন করতে পারেননি। এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আর সহ্য করতে পারেননি, দাঁড়িয়ে মন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, আপনি কি ফিফার ওজন বোঝেন?’</p> <p>কার্যতই ফিফা কিংবা আইওসির (ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি) দক্ষতা, ক্ষমতা ও পরিচিতিতে অনেক ভারী। ফজলুর রহমান পরে বুঝেছিলেন। সালাম মুর্শেদীর এখন সেই অবস্থা।</p> <p>মনে হচ্ছে, তাঁকেও ‘সালাম’ দেওয়া সময়ের দাবি!</p>